শুধু বাসমতী আর নববালা মুখ বাঁকিয়ে বলেছিল, ওসব মেডেল হচ্ছে রূপের, আর হাততালি
কিন্তু সে তো বলেছিল আড়ালে। লিলি যেন আহ্লাদে, গর্বে বিস্ময়ে, বৈকল্যে কেমনধারা হয়ে গিয়েছিল! এ যেন লিলি স্বপ্ন দেখছে।
লিলির মধ্যে এত ক্ষমতা ছিল! লিলির মধ্যে এমন আশ্চর্য শক্তি! ভাগ্যিস চারুর জ্বর হয়েছিল!
অভিভূত ভাবটা কাটলে লিলি হঠাৎ অন্য দিক দিয়ে ভাবতে শুরু করল। আর তখন লিলির মনে হল, ওই অধিকারী তার পরম শত্রু। কাউকে বুঝতে দিচ্ছিল না। এমন কি কুঞ্জকেও না। ছেলেবেলায় ধুতি পরিয়ে পরিয়ে বেটা ছেলে সাজাত, বড়ো হয়ে অবধি আর সাজতেই দেয় না। শুধু খুকি। সাজিয়ে রেখে দেয়। আবার বিয়ের জন্য ব্যস্ত।
তার মানে লিলির এই মস্ত গুণটাকে ফুটতে না দেবার ইচ্ছে। তবে? শত্রু ছাড়া আর কি? নেহাত চারুহাসিনী জ্বরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে, তাই বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে! তাই সেই একদিনের জন্যেই।
আগে থেকেই গাওনা হচ্ছে—একটা দিন করে দে, ভয় খাসনে। ভয় কি?
মুখের সামনে হাত-আয়না ধরে অনেকক্ষণ নিজের মুখটা দেখল লিলি। তারপর পনেরো বছরের লিলি ভাবল, এত রূপ গুণ থাকতে আমি কেন বেচারীর মতো পড়ে থাকিব? প্রোপাইটার যেন দয়া করে রেখেছে। দয়ার কি ধার ধারি?
এই তো নিজগুণেই বাজার মাৎ করে ফেললাম। ওই লেখক মুখপোড়া তো দুচক্ষের বিষ দেখে আমায়, কিন্তু যেই আমার নাম-যশ হয়েছে, অমনি সোধে সোধে গায়ে পড়তে এসেছে।
হাসিতে পেট ফুলে উঠল।…আসবে, সবাই আসবে।—ভালো ভালো পার্টি লুফে নিতে চাইবে। সেখানে কত মান, কত যশ, কত টাকা! এই তো চারুহাসিনীর কত মাইনে! লিলির আরও বেশি হবে, কারণ লিলির রূপ আছে।
কিন্তু এই স্বার্থপর কুঞ্জ দাসের কাছে পড়ে থাকলে? একটি পয়সাও না। এই তো আগে কত পার্ট করেছে। হোক গে ছেলের পার্ট, হোক গে একটুখানি, তবু পার্ট তো? কই তার দরুণ দিয়েছে একটা পয়সাও লিলিকে? দেবে কে? লিলি যে তীর কেনা! কেন? তিন বছরের একটা মেয়েকে পুষে তার মাথাটা জন্মের মতো কিনে নিয়েছেন! স্বার্থপর! বেহায়া! কুটিল!
লিলি আর এই স্বার্থপরতা সহ্য করতে পারবে না। লিলি পথ দেখবে। লিলি সেই পথ দেখার চেষ্টায় নিমাইকে ধরে পড়ে। বলে, নিমাইদা, কলকাতার রাজবাড়িতে আর দরকার নেই, চল—ভোগে পড়ি এইবেলা।
নিমাই পাকা-চোকা ছেলে। নিমাই ওর হাত ধরে বলে, কী সাজই সেজেছিলি, বাস্তবিক মনে হচ্ছিল পরী!।
বাচ্চা লিলি চোখমুখ ঘুরিয়ে বলে, আহা, সাজ তো কতা! পাগলিনী!
ওতেই তো আসরসুদ্ধ লোককে পাগল করে দিয়েছিলি বাবা! যে করে গিলছিল সবাই, মনে হচ্ছিল আমার জন্যে আর কিছু রাখবে না।
ভাগ ছোটোলোক! লিলি বাসমতীদের মতো ভঙ্গি করে।
তারপর ওরা বিচার করে সিদ্ধান্ত করে, এত গুণ নিয়ে এখানে পড়ে থাকার কোনো মানে হয় না। এখানে প্ৰাণপাত করেও বড়োজের দুখানা মেডেল, আর দুটো তোয়াজী কথা! তার বেশি নয়। তাছাড়া ভবানী অপেরার পালার বহরে তো শুধু ওই, পাগলিনী সাজ! লাভ নেই, রস নেই, সাজাগোছা নেই। অথচ অন্য অন্য পাটিতে? রানি সাজো, মহারানি সাজো, প্রেমিকা সাজো। যাত্রার আসরের প্রেমিকা আর রানি মহারানি ছাড়া আর অন্য কিছুই ভাবতে পারে না লিলি নিজেকে।
অতএব ঠিক হল, নিমাই আর লিলি নিজেরাই একটা দল খুলবে। ব্রজটাকে ভাঙিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে, লোকটা অধিকারীকে মোটেই দেখতে পারে না। বলা যায় না, জগাও যেতে পারে। অধিকারী বলবে অকৃতজ্ঞ? বললে তো বড়ো বয়েই গেল।— নিজে যে এতো স্বার্থপর?
বিবেকমুক্ত হল লিলি। নিমাই তো হয়েই ছিল।
কলকাতার কম্পিটিশন পর্যন্ত আর ধৈর্য ধরছে না। তাদের। তাছাড়া—লিলি বায়না ধরেছে আগে তাদের বিয়েটা সারা হয়ে যাক, তারপর যা হয় হবে।
প্রথমটা অবশ্য নিমাই বলেছিল, বিয়ে করলে তো বৌ হয়ে গেলি। ঘরের বৌকে কি আমি আসরে নাচাবা?
লিলি রেগে উঠে বলেছিল, তবে বিয়েটা কার সঙ্গে হবে শুনি? না কি হবেই না? তবে আমি তোমার সঙ্গে যাবই না।
অতএব বিয়ে। কালীঘাটে গিয়ে সিঁদুর নেওয়া। সে জানে, ব্ৰজ সব রকম সাহায্য করবে।
রাত্তিরে আর ফেরা সম্ভব হল না। রাতটা হাওড়া স্টেশনে খেয়ে আর শুয়ে সকালের গাড়িটা ধরল। কুঞ্জ-মেদিনীপুরের। পাঁশকুড়া থেকে বাসে তমলুক, তমলুক থেকে মহিষাদল।
রাত্রে খেয়ে আর শুয়ে হঠাৎ আশ্চর্যভাবে চিন্তার ধারাটা ঘুরে গেল কুঞ্জর। সমস্ত রাগ ঘৃণা ধিক্কার ঝাপসা হয়ে গিয়ে ভয়ানক একটা লজ্জায় যেন ঝুলে পড়ল কুঞ্জ। কী করে এসেছে সে! মড়ার ওপর খাড়ার ঘা দিয়ে এসেছে! ভুল মানুষেরই হয়, ওরাও হয়েছিল, কিন্তু সেই ভুলের খেসারতও দিতে হয়েছে কম নয়!
কুলত্যাগ করে চলে গিয়েও বিপদে পড়ে যে তার স্বামীকে মনে পড়েছিল, এতে কি বোঝায়? অথচ আজ কুঞ্জ সেই বিশ্বস্ত প্ৰাণটাকে পায়ে মাড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়ে এল!
কুঞ্জ টাকার খোঁটা দিল। ছিছি! এত নীচ কি করে হল কুঞ্জ? যদি এই ধিক্কারে ও টাকায় খেয়ে আর বেঁচে দরকার নেই ভেবে আত্মঘাতী হয়। উমা? হতে পারে। চিরকালের অভিমানিনী। মরবেই হয়তো। তাহলে বলতেই হবে, কুঞ্জ লোকটা খুনী! একটা মানুষের মৃত্যুর কারণ মানেই খুনী!
এখন কুঞ্জ যত ভাবতে থাকে, তার নিজের দিকের পাল্লাটা ততই অপরাধের ভারে বুকে পড়ে। মনের অগোচর পাপ নেই, লিলির সেদিনের সাফল্যে কুঞ্জ পূর্বের সমস্ত সংকল্প বিসর্জন দিয়ে ভাবেনি কি, বরাবরের মতো নায়িকার অভাব মিটাল কুঞ্জর? আর চারু ফারুর তোেয়াজ করতে হবে না।.তার মানেই উমা যা বলেছে তাই।