কিন্তু কুঞ্জকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ ঘরের মধ্যে এটা হাসি শোনা যায়। সত্যিকার খোলা গলার হাসি। তার সঙ্গে কথা, কে বললে বাহবা জোটেনি? বাহবা না জুটলে উচ্ছন্নে যাবার পথটা পরিষ্কার হল কিসে?
বাহবা! হুঁ! বাহবাটা কিসের?
কেন, রূপের!
রূপের! রূপের! ঝনঝনিয়ে উঠল রক্তকোষগুলো। সে রূপ বহু— বহুকাল দেখেনি কুঞ্জ। যে রূপের প্রতিমাকে হারিয়ে পৃথিবী বিস্বাদ হয়ে গিয়েছিল তার কাছে, আর যে রূপ এই দীর্ঘকাল হতভাগা কুঞ্জ দাসকে দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, সেই রূপের উল্লেখ! সহসা শরীরের সমস্ত রক্ত মাথায় চড়ে ওঠে কুঞ্জর।
কুঞ্জ সহসা চিৎকার করে বলে ওঠে, তা এতই যদি রূপের গরব, সেই রূপ ভাঙিয়ে খেলেই হত! এই গরিব হতভাগাকে বঁদের নাচাবার দরকারটা কি ছিল? কুঞ্জ এবার জিভ কামড়ায়, কুঞ্জ নিজের মুখের উপর নিজে থাবড়া মারে। কিন্তু হাতের ঢ়িল, আর মুখের কথা!
আশ্চর্য, আজই তো সবচেয়ে উৎফুল্ল মন নিয়ে এসেছিল কুঞ্জ। আশাভঙ্গ হল? তা না হয় তাই হয়েছে, তাই বলে কুঞ্জ এমন রূঢ় কথাট, বলবে? তার মানে, ওই মানুষটা ধরে নেবে, এই বিষ মনে পুষে রেখে সরলতার ভান করে নিয়মিত আসা যাওয়া করছে লোকটা, উদারতা দেখিয়ে টাকা দিচ্ছে। কুঞ্জ মরমে মরে যায়।
কিন্তু যাকে ওই বাক্যবাণটি বেঁধা হল, সে মরমে মরেছে এমন প্রমাণ পাওয়া গেল না। সে দিব্য স্বচ্ছন্দে জবাব দিল, মরতে বসেছিলাম যে! এখন তো সে পথ বন্ধ!
ওঃ! ওঃ! কুঞ্জর আবার সর্বশরীরে আগুনের হালকা ছুঁয়ে যায়। সমস্ত স্থৈর্য হারায়। কুঞ্জর সত্যিই মনে হয়, এই দীর্ঘকাল ধরে সে যেন একটা বদ মেয়েমানুষের হাতের সুতোর তালে বাঁদর নাচ নাচছে। এখন সে হি হি করে বলছে—মরতে বসেছিলাম! উপায় ছিল না …তাই তোমার মতোন বোকা গাধাটার শরণাপন্ন হয়েছিলাম। না হলে…ভাঙাতাম রূপ! বিধাতার দেওয়া ব্যাঙ্ক নোট!
এরপরও কুঞ্জ স্থৈর্য হারাবে না? কুঞ্জ দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ওঃ তাই! তাই—পাখিজুখি খাই না। আমি ধৰ্ম্মে দিয়েছি মন! আর আমি শালা একটা লক্ষ্মীছাড়া বদ মেয়েমানুষের পাল্লায় পড়ে— আবার ঢং কত! মেয়ে আমার আসরে নেচেছে, বাইজী হয়ে গেছে! ঠিক আছে, ও মেয়ে আর আমি রাখছি না। যার মেয়ে তার কাছে দিয়ে যাব, ব্যস! এই আমার সাফ কথা!
কুঞ্জ দালানের ধার থেকে ছাতাটা তুলে নেয়। ভিতর থেকে ঈষৎ ব্যস্ত গলা শোনা যায়, তা ঝগড়াটা তোলা থাক না এখন, হাতমুখ ধোওয়া হোক!
হাতমুখ ধোওয়া? কুঞ্জ ছিটকে ওঠে, আবার এখানে জলগ্ৰহণ করব আমি?…ভেবেছিলাম অনুতাপে নাকি সব পাপ ধুয়ে যায়। তবে কেন আর.যাক, ভালো শিক্ষাই হল। এই যাচ্ছি, কাল-পরশু এসে মেয়েকে ফেলে দিয়ে যাব, ব্যস!
কুঞ্জ ছাতাটা নিয়ে গঢ় গন্ট্র করে চলে যায়। বৃষ্টি পড়ছিল বির-ঝিরিয়ে, তবু ছাতটা হাতেই থাকে।
আজ আর স্টেশনে পড়ে থাকতে হবে না, এখনও ট্রেন আছে। কুঞ্জ তাড়াতাড়ি ট্রেনে উঠে বসে। আর অবাক হয়ে ভাবে, কী করতে এসেছিলাম। আমি, আর কী করে গেলাম!..আচ্ছা, কী কী বললাম। আমি।…মনে করতে পারল না, শুধু নিজের উপর অপরিসীম ধিক্কারে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে রইল। অথচ একটানা অনেকদূর যাবার পথ নয়, দেহটাকে নিয়ে বহু টানা-হেঁচড়া করে তবে গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে হবে। দল এখনও মহিষাদলে পড়ে। এই টানা-হেঁচড়া করেই এসেছিল, তখন গায়েও লাগেনি, এখন যেন আর দেহ চলছে না।–,
আশ্চর্য এতদিন ধরে কী করেছে কুঞ্জ? কুঞ্জ কি পাগল হয়ে গিয়েছিল? নাকি কুঞ্জকে কেউ মন্ত্র প্রয়োগ করে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিল? নইলে কুঞ্জ তার কুলত্যাগিনী স্ত্রীর একটা তু ডাক পেয়ে ছুটে গিয়ে তার বিপদে বুক দিয়ে পড়তে গেল?
বিপদ কি, না তার সেই পাপের সঙ্গীর মৃত্যু! কুঞ্জ তো তখন তীব্র ব্যঙ্গের হাসি হেসে আঙুল তুলে বলতে পারত, ঠিক হয়েছে! বোঝো—পাপের ফল! পারত, অথচ কুঞ্জ তা করল না।
কুঞ্জ সযত্নে তার সেই পরম শত্রুর শেষকৃত্য করল, কুঞ্জ তার কুলত্যাগিনী স্ত্রীকে মরতে বসা থেকে রক্ষে করল, আর তার একটা অবৈধ দায়িত্ব ঘাড়ে করল।
কুঞ্জ নিজেকে প্রশ্ন করে, কিসের লোভে এসব তুই করেছিলি হতভাগা? কিসের প্রত্যাশায়? কিছু না। তবে? নিশ্চয় ওই মেয়েমানুষটার গুণ-তুকের ফল। নইলে ওই তুচ্ছ একটা মেয়েমানুষকে এত ভয়ই বা কেন তার? তাই কিছুতেই সাহস সংগ্রহ করে একবার ঘরে ঢুকে পড়তে পারে না। বলতে পারে না, দেখি—সত্যিই তুমি সেই উমা কিনা!
আশ্চর্য, আজ পর্যন্ত ওর মুখ দেখল না কুঞ্জ, অথচ মাস মাস মাসোহারা ধরে দিয়ে যাচ্ছে! আর সেও দিব্যি অন্নান বদনে নিয়ে চলেছে। ভালো মেয়ে হলো নিতে লজ্জা হত না? সেই, সেই কথাই ভাবা উচিত ছিল কুঞ্জর। আর ঠাট্টা করা উচিত ছিল, মুখ দেখাতে লজ্জা তোমার, অথচ মুখে হাত তোলার খরচাটি নিতে তো লজ্জা নেই?
কিছু বলতে পারেনি কুঞ্জ। শুধু গাধার মতো গিয়েছে, আর টাকাটি দিয়ে চলে এসেছে। যেন তিনি নিলেই কৃতাৰ্থ! যত ভাবে ততই যেন নিজেকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে কুঞ্জর। চৈতন্য হবার যে এত যন্ত্রণা, তা জানত না কুঞ্জ।
কুঞ্জ ওই লিলিকে দিয়ে যাবে, ব্যস!
ভাবনার খেই ছেড়ে কুঞ্জকে গাড়ি বদল করতে হয়। এরপর আবার দুবার বাস বদল করতে হবে কুঞ্জকে।
০৪. আসর থেকে ফিরে আসতেই
আসর থেকে ফিরে আসতেই কুঞ্জ লিলিকে প্রায় কোলে করে নেচেছিল। দলের সবাই অভিনন্দন জানিয়েছিল।…এমন কি নাক-উঁচু বরুণও হঠাৎ ওর মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে