না? তবে যে বরুণ বলল! ওকি মিছে কথা বলবার ছেলে?
লিলি ক্রুদ্ধ গলায় বলে, না, মোটেই নয়! আমার নামে তোমার কাছে মিছে মিছে লাগিয়েই তো ও তোমার সুয়ো হয়েছে।
এই দেখো। নিন্দে কোথায়? সুখ্যাতি তো! বলছিল, লিলি ঠিক চারুর মতোন পার্ট বলতে পারে। লিলির গানের গলা আছে।
লিলি সন্দেহের সুরে বলে, তুমি বানাচ্ছি।
এই দেখো! আমার বানাবার দরকার কি? তবে ভাবলাম চারুর তো জুর, কে ওই পদ্মার পার্টটা করবে। বরুণ বলছিল তোর নাকি সব মুখস্থ!
লিলি এবার পুলকিত হয়। অতএব বলে ওঠে, শুনে শুনে মুখস্থ করেছি, বলব?
কুঞ্জ প্রসন্নমুখে বলে, বল।
লিলি মনশ্চক্ষে আসরের মাঝখানে নিজের শাড়িপরা মূর্তিটাকে দেখতে পায়। যে মূর্তি জ্বলন্ত ভাষায় বলছে, পাপা! পাপ! পাপের ভারে জর্জরিত পৃথিবী দুঃহাত তুলে আর্তনাদ করছে.শুনতে পােচ্ছ না তোমরা? ওই পাপ মায়ের বুক থেকে স্নেহ ছিনিয়ে নিচ্ছে, নারীর প্রাণ থেকে ভালোবাসা। আর পুরুষ জাতকে? শয়তানে পরিণত করেছে, নিষ্ঠুর নির্মম লোভী শয়তান! যে শয়তান ধর্ম মানে না, বিবেক মানে না, মানে না লজ্জা ভয়।…এই পাপের একটা পোশাকী নাম আছে, জানো তোমরা? জানোনা? হাঃ হাঃ হাঃ। সে নামটি হচ্ছে সোনা! বুঝলে?…যার পিপাসা রাবণের চিতার মতো শুধু জ্বলছে। নিবৃত্তি নেই।.এত সোনা দিয়ে কি করবে। গো? খাবে? বিছানা পেতে শোবে? হাঃ হাঃ হাঃ। মরণকালে কিসে করে নিয়ে যাবে? লোহার সিন্দুকে? …
পাগলিনীর সুর, পাগলিনীর ভঙ্গি। চোখে-মুখে কায়দা! কুঞ্জও পাগল হয়ে ওঠে। উদভ্ৰান্তের মতোন বলে, শাড়ি নিয়ে আয় একটা, মাটিতে আঁচল দুলিয়ে পর, চুলের দড়ি খুলে ফেল।
তোমার তেত্ৰিশ কোটির দিব্যিটা একদিনের জন্যে বাতিল করবে?
উত্তেজিত কুঞ্জ দাস ঘরের দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে বলে, এ শুধু হতভাগা কুঞ্জ দাসের মেডেল নয়, তোমার লিলির মেডেল! আসরে নেমেই বাজিমাৎ! ফাস্ট নাইটের মেডেল! বাড়ির কর্তা একটা দিল, আর মহারাজ গৰ্গ বাহাদুর একটা। কী হাততালির ঘটা! আসর ফেটে যায় একেবারে! হাজার হাজার দর্শক লাফিয়ে লাফিয়ে উঠেছিল। তখনি পাশের গায়ে আরও একটা বায়না হয়ে গেল।
ঘর থেকে সাড়া নেই। ঘর নিঃশব্দ! কুঞ্জ দাস গলা চড়ায় কথাগুলো কানে গেল না বুঝি? স্বভাবটি চিরকাল এক রইল। দেমাকীর রাজা! বলি মেডেলটা দেখা হবে? না কি তাতেও অগ্রাহ্যি?. তিন বছরের শিশুটাকে চোখ ছাড়া করে রেখে দিয়েছিলে, সে আজ মেডেল লুটে এনেছে, হাজার হাজার লোকের ধন্যি ধন্যি কুড়িয়েছে, এতেও নিয়ম ভেঙে একবার উঁকি দেওয়া যায় না?
এবার ঘরের মধ্যে থেকে স্বর আসে। শীতল কঠিন।
মেডেলটা লুটেছে তো আসরে নোচে কুঁদে?
হঠাৎ কুঞ্জ দাস যেন মাথায় একটা লাঠির ঘা খায়। লিলির ওই অভাবনীয় সাফল্যে কুঞ্জ যেন দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল, কুঞ্জ বুঝি নিজের নীতিও বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল। কম বয়েসে বিয়ে দিয়ে যাত্রার দল ছাড়া করে ঘরগেরস্থ করে দেবে লিলিকে, এই সংকল্পটার কথা মনেও ছিল না। আর!
কুঞ্জ আজ কদিন ধরে স্বপ্ন দেখছিল, আলোকোজ্জ্বল আসরে লিলি! আসর ফাটাচ্ছে, হাততালি কুড়োচ্ছে, মেডেল লুঠছে…! বারবার, বহুবার। অজস্র জায়গায়। অজস্র আসরে।
কুঞ্জ স্বপ্ন দেখছে, কলকাতার যাত্রা প্রতিযোগিতায় ফাস্ট হয়েছে কুঞ্জর ভিবানী অপেরা পার্টি থিয়েটারের মালিকরা এসে চুপি চুপি ধরনা দিচ্ছে মেয়েটাকে ভাঙিয়ে নেবার জন্যে।…আর কুঞ্জ সগর্ব হাস্যে বলছে, আজ্ঞে না বাবুমশায়, ও আমার মেয়ে, নিজের মেয়ে। ওকে আমি—
আর কুঞ্জ স্বপ্ন দেখছে, চারুহাসিনীকে আর তোয়াজ করতে হচ্ছে না, বার বার রিহার্সাল দেওয়াতে হচ্ছে না।
কুঞ্জর ঘরের মধ্যে এমন দামি রত্ব ছিল, আর কুঞ্জ তার খবর রাখত না? কুঞ্জ নিজেকে সাম্রাজ্যের অধীশ্বর ভাবছিল।…আর ভাবছিল, এই ভয়ঙ্কর আহ্লাদের ঢেউতে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। অন্তরালবর্তিনীর তুচ্ছ প্রতিজ্ঞা।
দুজনে পাশাপাশি বসে দেখবে লিলির মেডেল। সত্যিকারের মা বাপের মতো। কুঞ্জ যে ওর কেউ নয় বলতে গেলে শত্রুপক্ষ, তা তো কুঞ্জর মনে নেই। নিঃসন্তান কুঞ্জর অপত্য স্নেহাটা ওইখানে গিয়েই পড়েছে।
তবু কুঞ্জ যেন ঠিক ভোগ করতে পায় না। সন্তানকে সন্তানের মায়ের সঙ্গে না দেখলে কি সত্যকার আস্বাদ পাওয়া যায়? সেই আস্বাদ পেতে ছুটে এসেছিল কুঞ্জ! আগ্রহের মন নিয়ে। সেই মনে লাঠি খেল।
পাথরের দেওয়াল বলে উঠল, মেডেল তো আসবে নোচে কুঁদে?
কুঞ্জ ওই লাঠির ঘায়ে স্তব্ধ হয়ে গেল, তারপর কুঞ্জর নিজস্ব স্বভাব ফিরে এল। চড়া গলায় বলে উঠল, কুঞ্জ অধিকারী তোমার মেয়েকে বাইজীর নাচে নাচায়নি।
ভিতরের গলা সমান ঠাণ্ডা। মেয়ে আমার নয়, মেয়ে অধিকারীরাই। তবে গোড়া থেকে শুনেছি কি না। অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে ঘরগেরস্থিী করে দেওয়া হবে-
কুঞ্জ সক্রোধে বলে, তা সেটা হবে না, কে বলল? নিরুপায়ে পড়ে একদিন নামিয়ে দিলাম, মেয়ের এমন ক্ষ্যামতা যে তাতেই ধন্যি ধন্যি পড়ে গেল, মেডেল চলে এল, সেই কথাই আহ্বাদ করে বলতে এসেছিলাম। ওকে কি আমি দলে ভর্তি করে ফেলেছি?
আর করতে হবে না, ও নিজেই হবে।
নিজেই হবে!
হবে। বাহবার নেশা মদের নেশার বাড়া। উচ্ছন্ন দিতে সময় নেয় না।
কুঞ্জ উত্তর খুঁজে পায় না। তাই কুঞ্জ হঠাৎ একটা বেআন্দাজী চড়া কথা বলে বসে, কড়া আর চড়া বিদ্রাপের গলায়, তই নাকি? কিন্তু ওর মায়ের তো এত বাহবা। জোটেনি, তবু উচ্ছন্ন যেতেও আটকায়নি। বলে ফেলে কুঞ্জ নিজেই থতোমতো খেয়ে যায়। একথা বলার ইচ্ছে তো তার ছিল না।