একটুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে কুঞ্জ উঠে গেল। কুঞ্জ একা পায়চারি করতে করতে ওই জ্বলন্ত ভাষা আর চারুহাসিনীকে মনে করতে থাকে।
পারবে কি? পারবে বোধহয়! কলকাতার পুরানো রাজবাড়ি থেকে ঘোষণাটা একবার পেলে হয়।
কিন্তু হল একটা ব্যাপার।
কলকাতার ডাক আসবার আগেই মহিষাদল থেকে একটা ডাক আসে। জমিদারি না থাক জমিদার-বাড়ি। এখনও পুরানো ঐতিহ্য রয়ে গেছে। একমাত্র ছেলের পৈতে, সেই উপলক্ষে বিরাট ঘটা আর সেই ঘটনা উপলক্ষে যাত্রা আর কবিগান দেবেন তারা। দুর্গাপুজো মারফত কুঞ্জ অধিকারীর
কুঞ্জ বলে, আমি বলি কি নাট্যকার, তোমার ওই নতুন পালটাই লাগিয়ে দিই।
বরুণ বিস্মিত হয়। বলে, রিহার্সালের সময় কোথা?
হবে, হয়ে যাবে। কুঞ্জ আগ্রহের গলায় বলে, পিটিয়ে পিটিয়ে করে তুলব। মেদনীপুরের লোকের তোমার গিয়ে এই সব চেতনা বেশি। সেখানে তোমার এ পালা নামালে দেখবে কাণ্ড!
বরুণ হাসে, দেখুন!
কুঞ্জ কিন্তু হাসে না। কুঞ্জ সিরিয়াস গলায় বলে, দেখব না, দেখেছি। তুমি যদি আমার সঙ্গে থাক নাট্যকার, কোনো বাধাকেই ভয় করি না।
বলে বটে। অথচ ভাবে বরুণ তার কে? বরুণ তার নাটকের নাট্যকার, এইমাত্র। বলতে গেলে পথে কুড়োনো। আর বলতে গেলে কুঞ্জরই গঠিত বিগ্রহ।—
কোথায় যেন দল নিয়ে চলেছে কুঞ্জ, হঠাৎ রুক্ষুমাথা, ধুলোভর্তি পায়, আধ্যময়লা ধুতি শার্ট পরা ছেলেটা রেলগাড়িতে উঠে পড়ে বলে, পয়সা নেই, বিনাটিকিটে উঠেছি, আমার ভাড়াটা দিয়ে দিন না।
চমৎকৃত কুঞ্জ চমৎকার ভাবটা গোপন করে বলে, তা খামোেকা আমি তোমার রেলভাড়াটা দিয়ে দেব কেন হে বাপু? তুমি আমার কে, বাপের ঠাকুর চোদ্দপুরুষ?
ছেলেটা দমেনি। বলেছিল, এরাই বা আপনার কে? এই যে দলবল নিয়ে যাচ্ছেন?
এরা? এরা তো আমার দল। ভবানী অপেরার নাম শুনেছি? আমি হচ্ছি। তার প্রোপ্ৰাইটার কুঞ্জবিহারী দাস।
ছেলেটা বলেছিল, নাম শুনিনি, এই শুনলাম। তা বেশ তো, আমাকেও দলের লোক করে নিন।
চাইছে, অথচ প্রাথীর ভাব নেই, যেন দাবির সুর। কুঞ্জর ভালো লেগে গেল। হাত কচলানো কৃপাপ্ৰাথী দেখে দেখে অরুচি। আর তা না হল তো তেজে মটমট! এর ভাব আলাদা! কুঞ্জ সকৌতুকে বলল, তা দলে না হয় নিলাম। কিন্তু তোমার কি গুণ আছে শুনি?
ছেলেটা বলল, গুণ কিছু নেই, তবে যাত্ৰা-নাটকের পালা লিখতে পারি কিছু কিছু।
পালা লিখতে পারে! আহা-হা, এই লোকই তো খুঁজে বেড়াচ্ছে কুঞ্জ—যার ক্ষমতা আছে, অথচ আত্মঅহমিকাবোধ নেই। এর নেই, দেখেই বুঝেছে কুঞ্জ। নিজের গুণ সম্পর্কে যেন তাচ্ছিল্য ভাব! ব্যস। সেই রেলগাড়িতেই হয়ে গেল সম্পর্ক স্থাপন।
তারপর-কুঞ্জর উৎসাহ, প্রেরণা আর বিরুণের সহজাত ক্ষমতা। কুঞ্জ অবশ্য বলে, লেখাপড়া জানা ভদ্র। কিন্তু বরুণ নিজে কোনোদিন নিজের পরিচয় দেয়নি। বলে, মায়ে-তাড়ানো বাপেখেদানো রাস্তার ছেলে! ব্যস। এই হচ্ছে আমার পরিচয়।
তবু কোথায় যেন দূরত্ব আছে। আছে অভিজাত্য। কুঞ্জ তাকে বশ করে কেনবার সংকল্প নিয়ে নিজেই বশ্যতা স্বীকার করে বসে আছে। কুঞ্জ তার মহিমায় বিবশ। কুঞ্জ দলের আর সকলের উপর রাজা, বরুণের কাছে প্ৰজা, তাই বরুণ থাকলে সে আর কিছু ভাবে না।
মহিষাদলে যাবার তোড়জোড় চলে, আর চলে জোর মহলা। কয়েকদিনের মধ্যে তৈরি করতে হবে।
হঠাৎ এই মোক্ষম সময়, যখন আর দিনতিনেক দেরি, চারুহাসিনী পড়ল জুরে। রীতিমতো জুর। যে চারুহাসিনীর ভূমিকা উন্মাদিনী নায়িকার।
কুঞ্জ নিজের মাথাটা দেয়ালে ঠুকে গুঁড়ো করতে যায়। কুঞ্জ বুকে কিল মারতে যায়। এখন কী করবে। সে? নববালা? বাসমতী? ছি ছি!
হঠাৎ বরুণ বলে বসল, ভাবছেন কেন অত? আপনার লিলিকে নামিয়ে দিন না।
লিলি! কুঞ্জ দাস হকচাকিয়ে বলে, সে কী!
কেন, অবাক হবার কি আছে? বরুণ অবহেলাভরে বলে, রিহার্সাল শুনে শুনে তো ওর মুখস্ত। যখন তখনই তো আওড়ায়। গানও তোলে।
ইদানীং আর অনেকদিন কমবয়সী ছেলের পার্টের দরকার হয়নি। তাই লিলির কথাটা যেন ভুলেই গিয়েছিল প্রোপ্ৰাইটার। লিলি শুধু কোমরে বেল্ট বেঁধে সেই কোমরে হাত দিয়ে দলের ওপর সর্দারি করে বেড়ায়।
কুঞ্জ সে খোঁজ রাখে না, তাই কুঞ্জ অগ্রাহ্যের হাসি হেসে বলে, মুখস্ত হলেই তো হল না হে! মানবে কেন? ওটা হল একটা যুবতী মেয়ের পার্ট।
বরুণ অন্যদিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে বলে, আপনার লিলিকে তাতে বেমানান হবে না। ঘাগরা
কুঞ্জ তথাপি হাসে, আহা, গড়নটা একটু বাড়ন্ত, তা বলে কি বয়েসের ভাবটা আনতে পারবে?
বরুণ তাচ্ছিল্যাভরে বলে, পারে কি না, আসরে নামিয়ে দিয়ে দেখুন। বয়েস আর ছোটো নেই ওর।
বরুণের মুখে আরও আসছিল—বলে আর ওই নিমাই কোম্পানির দলে ছেড়ে দিয়ে আড়াল থেকে দেখুন।
কিন্তু বলে না। ভাবে, আমার কি দরকার! মেয়েটাকে সে ওই পাকামির জন্যেই দেখতে পারে না। তবে অস্বীকার করতে পারে না, মেয়েটার মুখস্থ করার ক্ষমতোটা।
ওরা যে যার পার্ট রিহার্সাল করে, লিলি শুনে শুনে সবাইয়ের পার্ট মুখস্থ করে ফেলে। ভাবভঙ্গি কিছুই বাদ যায় না। গানও তোলে। তবে কুঞ্জ সম্পর্কে সাবধান থাকে। কুঞ্জ বাড়ি থাকলে গলা তোলে না, পাছে বকে। বকবে, এই ধারণাটাই ছিল লিলির।
বরুণের কাছ থেকে লিলির নাম প্রস্তাবে কুঞ্জ খুব একটা আশান্বিত না হলেও, ঈষৎ কৌতূহলোক্রান্ত হয়েই ডেকে পাঠাল লিলিকে। তারপর বলল, তুই পার্ট মুখস্থ করিস?
লিলি ভয় পেল। বলল, না তো।