কুঞ্জর পুষ্যি মেয়েটা দুদে বলে কুঞ্জর শান্তি! আর কুঞ্জ তার পাত্ৰ ঠিক করে ফেলেছে বলে কুঞ্জর শান্তি! তবু পত্রটাকে এখনও বাজিয়ে নিতে বাকি।
সেই বাজানোর পদ্ধতিটাই ধরে কুঞ্জ। লিলিকে ডেকে ডেকে বলে, সারাদিন শুধু হি হি করে বেড়াস কেন? শেলেট পেন্সিলটা নিয়েও বসতে পারসি দুদণ্ড! বাড়িতে একটা লেখা-পড়া জানা ভদ্র ছেলে রয়েছে, তার কাছেও একটু পড়া বুঝে নিলে হয়। তা নয়। কেবল ওই মুখুগুলোর সঙ্গে—
বরুণদা পড়াবে আমাকে? তা হলেই হয়েছে! লিলি ঠোঁট উল্টোয়।
কুঞ্জ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
আবার এক সময় অন্য পথ ধরে কুঞ্জ। বলে, লিলি, যা দিকি—বরুণকে এক পেয়ালা কড়া করে চা দিয়ে আয় দিকি। রাত জেগে বই লেখে! দেখিস যেন আর কাউকে বরাত দিসনি, নিজে করে। দিবি।
লিলি প্রোপ্ৰাইটারের কথা ঠেলতে পারে না। কিন্তু খানিক পরে লিলি রাগ করে ফিরে আসে, আর ককখনো বরুণদাকে চা করে দেব না। এত বকে!
বকে? বাকবে কেন?
কেন? তোমার ভালো ছেলে ভাদর ছেলে যে! চা দিতে গিয়েছি, বলে কি না কে তোকে চা নিয়ে আসতে বলেছে? চা খেতে চেয়েছিলাম আমি? খবরদার যদি আর কখনও শুধু শুধু এ ঘরে আসবি তো দেখাব মজা। যা, ফেলে দিগে যা। লিলি কাঁদো কাঁদো হয় এবার।
কিন্তু কুঞ্জর মুখ হাসি হাসি। কুঞ্জর যেন অঙ্কের ফল মিলে গেছে। কুঞ্জ বলে, তুই বললি না। কেন, প্রোপ্ৰাইটার বলেছে।
বলতে সময় দিয়েছে? দূর দূর, ছেই-ছেই! শেষকালে যখন বললাম, ফেলে দেবে তো— পোপাইটারের সামনে গিয়ে ফেলে দাও গে। যে চা দিতে বলেছে—তখন বলল,—দে, দিয়ে যা।
কুঞ্জ মৃদু হেসে বলে, রাত-দিন চড়া চড়া পালা লেখে তো? মেজাজটা তাই চড়া। তার মুখে প্ৰসন্নতার দীপ্তি–এই ঠিক ছেলে!
মেয়ে মানুষকে দূর দূর করে মানেই, বিয়ে করা পরিবার ছাড়া জীবনে ও আর কারুর দিকে তাকবে না। তা ছাড়া লিলির সঙ্গে গেথে দিতে পারলে চিরকাল আমার কাছে বাঁধা থাকবে লেখক। আর লিলিও কাছে থাকবে।
কুঞ্জ বরুণের ঘরে এসে ঢোকে।—চা দেখে রেগে উঠলে কেন গো নাট্যকার? রাত জেগে লেখো, তাই ভাবলাম একটু কড়া করে চা খেলে—
না না, আমি ওসব পছন্দ করি না—! বরুণ বিরক্ত গলায় বলে, খুব খারাপ লাগে আমার ওই মেয়ে-ফেয়ে ঘরে ঢোকা।
কুঞ্জ উদার গলায় বলে, আরে বাবা, একটা বাচ্চা মেয়ে—
তা হোক! বরুণ রুক্ষ গলায় বলে, বারণ করে দেবেন।
কুঞ্জ হৃদ্যতার গলায় বলে, তা না হয় দিলাম। কিন্তু মেয়েছেলে দেখলেই যদি তোমার এত গা জ্বলে, বে। থ্যা করবে কি করে?
বিয়ে করব, এ কথা আপনাকে বলতে যাইনি।
কুঞ্জ হেসে উঠে বলে, আহা তুমি তো বলতে যাওনি, কিন্তু আমি তো মনে মনে ঠিক করে রেখেছি তোমাকে ঘর সংসারী করে দেব।
বরুণ হঠাৎ ভুরু কুঁচকে বলে, কেন? হঠাৎ আমার প্রতি এমন নেক নজর কেন?
আহা, তুমি রাগ করছ কেন? তোমাকে যে আমার ভারী পছন্দ, তাই!
বিয়ের সঙ্গে তার কি সম্পর্ক? পছন্দ করেন, করুন।
নাঃ, এখন তোমার মেজাজ ভালো নেই, থাক ও কথা! পালাটার কতদূর হল?
এগোচ্ছে।
শুনতে পাই না একটু?
বরুণ একবার এই লোকটার প্রাথী-প্রাথী মুখের দিকে তাকায়। এটাও আশ্চর্য! দলের আর সকলের ওপর ব্যবহার তো দেখেছে, যেন হাতে মাথা কাটছে। অথচ বরুণের সামনে যেন বেচারী! যেন কৃতাৰ্থস্মন্য অধস্তন! তার মানে বরুণের মধ্যেকার শিল্প-স্রষ্টাকে শ্রদ্ধা করে ওই গোঁফওয়ালা বেঁটে-খাটো লোকটা। বরুণ হঠাৎ নিজের রূঢ়তার জন্য লজ্জিত হয়। বলে, আচ্ছা, শুনুন খানিকটা—
পড়ে কিছুক্ষণ, তারপর মুখে মুখে বাকিটা শোনায়। একজন ভেজালদার কালোবাজারি ঘিয়ে বিষাক্ত চর্বি ভেজাল দিয়ে কেমন করে নিজের পরিবারের সকলের মৃত্যু ডেকে আনল, আর তারপর ভেজালদারের একমাত্র জীবিত কন্যা পদ্মা উন্মাদিনী হয়ে গিয়ে কীভাবে জ্বলন্ত ভাষায় জগতের সমস্ত লোভী মুনাফাখের আর ভেজালদারদের উদ্দেশে অভিসম্পাত দিয়ে বেড়াতে লাগল, এ তারই কাহিনি।
আধুনিক কোনো একাঙ্কিকা নাটিকার নাট্যকার বিরুণের নাটককে কানাকড়িও মূল্য দেবে কিনা সন্দেহ। বরং হয়তো তার মোটা আদর্শ, আর তার মোটা প্রকাশভঙ্গি দেখে কৌতুকের হাসি হাসবে, তবু বরুণরাও একেবারে অসাৰ্থক নয়। তাদেরও গুণগ্রাহী আছে, তাদেরও শ্রোতা আছে, দর্শক আছে।.সূক্ষ্ম রসের সমজদারই বরং কম। এই মোটা রসের মানুষই তো দেশজুড়ে। দেশ যতই তার সাহিত্য আর শিল্পের উৎকর্ষের বড়াই করুক, আজিও নাটকান্তে নায়িকাকে পাগলিনী করে ছেড়ে দিয়ে তার মুখের অসংলগ্ন ভাষার মধ্যেই নাট্যকারেরও মূল বক্তব্যটি চালিয়ে দেওয়ার যুগ প্রায় অবিচলই আছে।
কাজেই কুঞ্জ অধিকারী বরুণের মুখে নাট্যকাহিনি শুনতে শুনতে রোমাঞ্চিত হয়, আর কল্পিত এক আসরে বসে হাজার হাজার করতালির ধ্বনি শুনতে পায়।
হঠাৎ তাই বরুণের হাতটা চেপে ধরে কুঞ্জ বলে, এইটাই তুমি ভালো করে খাড়া করে ফেল লেখক! কলকাতার পুরনো রাজবাড়ির যাত্রা অপেরা কম্পিটিশনে এটাই নামাব।
বরুণ ওই আসায় উদবেল আগ্রহ-ব্যাকুল মুখের দিকে তাকায়, আর আস্তে আস্তে হাসে। বলে, সবটা করে দেখি কেমন দাঁড়াবে।
তোমার হাতে আবার কেমন দাঁড়াবে! অপূর্বই দাঁড়াবে। কুঞ্জ ওর হাতটা আরও জোরে চেপে ধরে বলে, নাট্যকার, তুমি কখনও আমায় ছেড়ে যেও না।
বরুণের মুখে আসছিল, ম্রোতের শ্যাওলা কি কখনও এক জায়গায় আটকে থাকে? কিন্তু বলতে পারল না। ওই বয়স্ক লোকটার নির্ভরতায় ভরা মুখটার দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল। তারপর লেখা কাগজগুলোয় মন দিল।