সাধ নেই দেখবার, তবু কুঞ্জ দাস তার নাটকের সেই ছেলে-সাজা মেয়েটার ফটোগ্রাফ তুলে তুলে মাঝে মাঝে ওই নোটের গোছার সঙ্গে দরজার বাইরে রেখে যায়।
ঘরের ভিতর থেকে তাচ্ছিল্যের স্বর ভেসে আসে। দরকার ছিল না। না দেখে মরছিল না। কেউ।
কুঞ্জ চটে যেত। বলত, কেনই বা মরে না? মরবার তো কথা। গর্ভে ধরলেই তার ওপর মায়ার টান–
সবই কি আর এক নিয়মে চলে? বিতেষ্টাও থাকতে পারে।
হুঁ! অবোধ শিশু, তার ওপর বিতেষ্টা! আর—
শব্দভেদী বাণ বলে, থামা হল কেন? সবটা হয়ে যাক?…আর পাপে বিতেষ্টা ছিল না, অনাচারে বিতেষ্টা ছিল না, এই সব তো?
কুঞ্জ বলত, সোধে সোধে অপমান গায়ে মাখা! কুঞ্জ দাস অত ছোটো কথা কয় না।
আমার ঘাট হয়েছে।
এই তর্কাতর্কি কখনও কখনও বাতাস উত্তপ্ত করে তুলত। কুঞ্জ বলত, আর আসব না।
ঘরের দেওয়াল তখন হেসে উঠত। বলত, টাকাটা তাহলে মনিঅৰ্ডারে আসবে? না কি বন্ধ?
কুঞ্জ রাগ করে বলত, সাধে আর বলেছে বদ মেয়েছেলে!
চলে যেত গটগটিয়ে। আবার আসত। বরং সেবারে আরও তাড়াতাড়ি আসত। ক্রমশ এই আসাটা চন্দ্ৰ সূর্যের মতো নিশ্চিত নিয়ম হয়ে গেছে। আসবেই কুঞ্জ। নতুন মেডেল পেলে সেটা দরজায় ফেলে দিয়ে বলবে, দেশসুদ্ধ লোক পুজো করে বৈ হেনস্তা করে না। মেডেল কেউ আমনি দেয় না।
কোনো বই খুব নাম করলে, এসে ওই উল্টোমুখে বসে পা দোলাতে দোলাতে বলে, হাজার হাজার লোক দেখছে, আর অহঙ্কারীদের গারবে মাটিতে পা পড়ে না!
ঘরের দেওয়াল বলে, দেখাটা হবে কেমনে করে? আসরের কানাচে হাড়ি বাইরীদের দলে বসে?
সে কথা কেউ বলেছে? কুঞ্জ রেগে ওঠে।
জবাব আসে হাসির সঙ্গে, বলবে কেন? যা ঘটবে সেটাই হচ্ছে কথা।
কুঞ্জ চুপ করে থেকেছে। কুঞ্জ আর কোনো আশ্বাসের কথা খুঁজে পায়নি তখন। তারপর হয়তো কুঞ্জ সহসা বলে উঠেছে, তেত্ৰিশ কোটি দেবতার দিব্যিটা কি জীবনভোর পালতে হবে?
ঘরের মধ্যে একটা অস্ফুট আওয়াজ যেন চমকে উঠেছে। তারপর আস্তে আস্তে যেন ঘুমন্ত মানুষ কথা বলেছে, দেবতার দিব্যি জন্মভোর কেন, জন্ম-জন্মান্তর পালতে হয়।
তেত্ৰিশ কোটি তো আছে ঘেঁচু। মা-কালী এর মধ্যে পড়ে না।
পড়ে? মা-কালীকে অগ্ৰে নিয়ে তেত্ৰিশ কোটি।
দিব্যি দেবার আর বস্তু খুঁজে পেল না! ছ্যাঃ, যেমন বুদ্ধিতে চলল চিরদিন!
আক্ষেপ, রাগ, অসহিষ্ণুতা এই ছিল সমাপ্তি সঙ্গীত। ক্রমশ সেটাও গেছে। এখন শুধু যেন অন্ধ একটা নেশার অভ্যাস। আসে, উল্টোমুখো হয়ে বসে পা দোলাতে দোলাতে বাতাসকে কথা বলে, পুকুরে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আসে, একবেলার ভাতটা খায়, তারপর ছাতাটি নিয়ে স্টেশনে গিয়ে টিনের চালার নীচে সারারাত পড়ে থেকে, সকালের গাড়িতে ফেরে।
রাতে থাকার কথা ওঠে না। নানান জায়গায় থাকা, নানান দেশ থেকে বায়না, কত লাইনের গাড়িতে চড়তে হয়। দলবল নিয়ে, কিন্তু এই আমতা লাইনটায় কখনও ভুল হয় না।
প্রথমবার ভাত পায়নি। কুঞ্জ যা দোকানের মিষ্টি এনে ধরে দেয় একরাশ, তাই থেকেই সাজিয়ে গুছিয়ে ধরে দেওয়া হয়েছিল কুঞ্জর সামনে। কুঞ্জ রেগে উঠে বলেছিল, ভাতের আগে এই এত সব খেতে হবে?
ভাত!
ঘরের মধ্যে থেকে একটা প্ৰেতাত্মার ছায়া কণ্ঠ বলে উঠেছিল, ভাত খাওয়া হবে এখানে?
হবে না তো কি এই পিণ্ডিগুলো গিলে রাত কাটাতে হবে? ভাত ছাড়া রাতে আর কিছু খাই কখনও আমি?
সেই স্বর বলেছিল, এখানে আমি ছাড়া আর কে আছে রাঁধবার?
কুঞ্জ ব্যস্ত হয়ে বলেছিল, ওঃ, তা শরীর বুঝি ভালো নেই? তবে থাক, তবে থাক। কুঞ্জ ওই কণ্ঠস্বরের মধ্যে বোপাকরি ভয়ানক একটা ক্লান্তির আভাস পেয়েছিল। কিন্তু সে উত্তরটা পেল উল্টো।
শরীর খুব ভালো আছে। হাতে খাওয়া হবে কি না সেই কথাই হচ্ছে।
ওঃ হাতে খাওয়া!
কুঞ্জ একটা বিদ্রাপের হাসি হেসে উঠেছিল, ধৰ্মজ্ঞান! বলি জলটা দিল কে?
জলে আর ভাতে অনেক তফাত।
কিছু না, কিছু না, কোনো তফাত নেই। খাওয়া নিয়ে কথা। বলেই কুঞ্জ আরও হেসে ওঠে, আর সে ধরতে গেলে তো জাতে উঁচু হয়েই যাওয়া হয়েছে। কুলের মুখুটি মুখুজ্যে কুলীন।
ভিতরে স্বর এবার সজীব সতেজ, আরও একটা কথা আছে। কাশির ব্যামো হয়েছিল—
রোগ সারলে আর রুগী কিসের? বেশি কষ্ট না হলে ভাত দুটো চড়ানো হোক। সেই থেকে ওই একবেলা ভাত, আর তার সঙ্গে এক পাহাড় কথা!
কথা, কথা! কথা কইবার জন্যেই যেন ছুটে আসে কুঞ্জ। অথচ একটা অশরীরী আত্মার সঙ্গে কথা। আর নতুন কথা কিছুই নেই। তবে ইদানীং কুঞ্জর ওই পুষ্যি মেয়েটার বিয়ের কথা নিয়ে কথা চালায় কুঞ্জ। তার সঙ্গে নিজের বুদ্ধির বড়াইও।
উঁহু, কাপড়-ফাপড় দিইনি। এখনও। ওই ঘাগরা পরিয়েই ছেড়ে ছেড়ে রেখেছি। বয়েস ধরা যায় না। তা ছাড়া স্বভাবেও একেবারে বাচ্চা! মায়ের তো কাঠ কবুল প্রতিজ্ঞে দেখব না, নইলে মনে হয় নিয়েই চলে আসি। এত বায়না করে! হাত ধরে ঝুলে পড়ে।
অত আহ্লাদেপনা কেন?
আহ্লাদেপনা আবার কি? একটাও স্নেহ মমতার জায়গা তো থাকবে মানুষের?
সম্পর্কটা বেশ ভালোই পেয়েছে। একটু হাসির শব্দও আসে কথার সঙ্গে।
সম্পর্ক! সম্পর্ক নিয়ে কে ধুয়ে জল খাচ্ছে? তবে এই আগে থেকে বলে রাখছি, বিয়ে দিয়ে জামাই মেয়ে এনে দেখাবই। তিন সত্যি!
পরিচয়টা কী দেওয়া হবে?
সে আমি বুঝব।
আবার আসে—
বলে, মনঃস্থির করেছি, তবু এখনও আরও কিছু বাজিয়ে নিতে বাকি। তবে দেরি করব না, ছেলে-বয়স থাকতে থাকতেই দল থেকে সরাতে হবে। অবিশ্যি খুব দুদে আছে মেয়েটা, কাউকে পরোয়া করে না, সব কাঁটার সঙ্গে ঝগড়া। তাই আমার শান্তি।