বাড়ির লোক অন্য অনেক কিছু না বুঝুক, এটা বোঝে।
তাই প্রত্যক্ষে এবং পরোক্ষে অনামিকা দেবীকেই দায়ী করে শম্পার বেচালের জন্যে।
বড় গাছে নৌকো বেঁধেছে যে —, ছোট বৌদি দেওয়ালকে উদ্দেশ করেই বলেন, ভয় কেন থাকবে? শুধু আমার নিজের হাতে মেয়ে থাকলে, কেমন না ঢিট করতাম দেখত সবাই। ছেলে জন্মাবার পর অনেকগুলো বছর বাদে শম্পার আবির্ভাব হয়েছিল। বড়ো বয়সের এই মেয়েটাকে এঁটে উঠতে কোনো দিনই পারেন না ছোট বৌদি, কিছু দোষারোপটা করেন অনামিকাকে।
অনামিকা দেবী তাই মাঝে মাঝে বলেন, তোর মাকে জিজ্ঞেস কর না বাবা! তোর মাকে বলে যা না বাবা!
শম্পা চোখ গোল করে বলে, মাকে? তাহলে আজকের মত বেরোনোর মহানিশা। কেন কি বৃত্তান্ত কোথায় কার সঙ্গে? ইত্যাদি, প্রভৃতি সে কী জেরা! উঃ, কী একখানা ব্রেন! মার বাবা যদি মাকে লেখাপড়া শিখিয়ে উকিল করে ছেড়ে দিতো, তাহলে দেশের দশের উপকার হতো, আর এই শম্পাটারও প্রাণ বাঁচত। কেন যে সে বুদ্ধিটা মাথায় আসেনি ভদ্রলোকেরা!
অনামিকা ওর এই কথার ফুলঝুরিতে হাসেন, কিন্তু অনামিকার সেই হাসির অন্তরালে একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস স্তব্ধ হয়ে থাকে।
তোরা আজকের মেয়েরা জানিস না, খেয়ালও করিস না, তখন কোনো ভদ্রলোকের মাথাতেই ও বুদ্ধিটা আসতো না। আর যদি বা দৈবাৎ কারো মাথায় আসতো, লোকে তাকে তখন আর ভদ্রলোক বলতো না।
তাই এমন কত মস্তিষ্কই অপচয় হয়েছে, কত জীবনই অপব্যয়িত হয়েছে। আজ পৃথিবী তোদের পায়ের তলায়, আকাশ তোদের মুঠোয়, তোরা নিজের জীবনকে নিজের হাতে পাচ্ছিস, আর তার আগে সেটা গড়ে দিচ্ছে তোদের গার্জেনরা।
তোরা কি বুঝবি গড়নের বালাইহীন একতাল কাদার জীবনটা কেমন? তাও সেই বাঁকাচোরা অসমান ডেলাটাও অন্যের হাতে!
সেই অন্যের হাতের চাপে বিকৃত অসমান কাদার জীবনকে দেখেছি আমরা, তাই ভাবি তোরা কত পেয়েছিস! কত পাচ্ছিস! কিন্তু সে বোধ কি আসে কোনোদিন তোদের? কিন্তু কেনই বা আসবে? প্রাপ্য পাওনা পাওয়ার জন্যে কি কৃতজ্ঞতা আসে?
বুকভরা নিঃশ্বাস নেবার মত বাতাস থাকলে কি কেউ ভাবতে বসে কে কবে কোথায় বাতাসের অভাবে দম আটকে মরেছে?
বকুলের ছবিটা একবার ভেসে এসেছিল বহু যুগের ওপার থেকে, কিন্তু তার খাতাটা? সেটা যে কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছেন না অনামিকা দেবী। খোঁজবার জায়গাটাই খুঁজে পাচ্ছেন না।
তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন, আর মনে হচ্ছে, এই সব নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর উপাদানের মধ্যে বকুলকে কোথায় পাবো?
বকুল বাপ-ভাইয়ের কঠোর শাসনে তার ভালবাসাকে লোহার সিন্দুকে পুরে ফেললো, এটুকু তো দেখতে পেলাম। কিন্তু সেটা কি একটা বলবার মত উপকরণ?
অথচ বকুলের কথা লেখবার জন্যে কোথায় যেন অঙ্গীকার ছিল। সে অঙ্গীকার কি ভুলে গেছেন অনামিকা দেবী?
ভুলে হয়তো যাননি, তবু কত হাজার হাজার পৃষ্ঠা লেখা হল জীবনে, কত হাজার হাজার বানানো মানুষের কথা, অথচ সেই কথাটা চাপা পড়ে রইল।
কিন্তু ও নিয়ে এখন আর ভাবনার সময় নেই। বনবাণীর সম্পাদক টেলিফোনযোগে হতাশ গলায় জানাচ্ছেন, আপনার কপিটার জন্যে কাগজ আটকে রয়েছে অনামিকা দেবী। সামনের সপ্তাহে বোরোবার কথা, অথচ-
বনবাণীর পরেই সীমান্তের কপি, তারপর অন্তহীন সাগরের প্রুফ। তার ভিতরেই তো উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন।
দিন আষ্টেক পরে সেজদির চিঠির উত্তর দিলেন, বকুলের খাতাটা কোথাও খুঁজে পেলাম না মনে হচ্ছে হারিয়েই ফেলেছি। আর তার সঙ্গে মনে হচ্ছে, হয়তো তোর কাছেই আছে। দেখা না খুঁজে।
০৪. মেয়েরা শাড়ি কুঁচিয়ে নিয়ে পরতো
আগেকার দিনে মেয়েরা শাড়ি কুঁচিয়ে নিয়ে পরতো। হালকা মিহি ‘খড়কে ড়ুরে’ ‘চাঁদের আলো’ ‘গঙ্গাজলী’। কড়া করে মোচড় দিয়ে দিয়ে পাকানো সেই কোঁচানো শাড়িকে বাঁধন খুলে বিছিয়ে দিলে, তার ছোট ছোট ঢেউতোলা জমিটা যেমন দেখাতো, গঙ্গাকে এখন যেন তেমনি দেখতে লাগছে।
জোয়ার নেই, ভাঁটা নেই, স্থির গঙ্গা।
শুধু বাতাসের ধাক্কায় ছোট ছোট তরঙ্গ। সেই তরঙ্গ কোঁচানো গঙ্গাজলী শাড়ীর মত একূল ওকুল আঁচল বিছিয়ে তিরতির করে কাঁপছে।
এখন পড়ন্ত বিকেল, এখন গঙ্গা আর গঙ্গাতীরের শোভার তুলনা নেই, এই শোভার শেষবিন্দুটুকু পান করে তবে এই বারান্দা থেকে উঠবেন সেজদি। যার নাম পারুল, আর যাকে নাম ধরে ডাকবার এখানে কেউ নেই।
এই তার পুজো, এই তার ধ্যান, এই তার নেশা। রোদ পড়লেই গঙ্গার ধারের বারান্দায় এসে বসে থাকা। হাতে হয়তো একটা বই থাকে, কিন্তু সে বই পড়া হয় না। এ সময়টা যেন নিজেকে নিয়ে ওই গঙ্গারই মত কোনো অতল গভীরে ড়ুবে যান তিনি।
ফর্সা রং, ধারালো মুখ, ঈষৎ কোঁকড়ানো হালকা রুক্ষ চুলে রুপোলি ব্রাশের টান। সম্পূর্ণ নিরাভরণ হালকা পাতলা দেহটি ঘিরে যে সাদা থান আর ব্লাউজ, তার শুভ্রতা যেন দুধকেও হার মানায়। সাদা ফুলের সঙ্গেই বরং তুলনীয়।
পাড়ার মহিলারা কখনো কখনো বেড়াতে আসেন, সধবা বিধবা দু দলই। আর পথে বেরোলে অবশ্যই ফর্সা কাপড় পরেন, কিন্তু এখানে এসে বসলে তাদের সে শুভ্রতা সম্ভ্রম হারায়।
মহিলারা বিস্ময়-প্রশ্ন করে বসতেও ছাড়েন না, কোন ধোবায় আপনার কাপড় কাচে দিদি? কী ফর্সা করে! আর বাড়িতেও যে আপনি কি করে কাপড় এত ফর্সা রাখেন! আমাদের তো বাবা রান্নাঘরে গেলাম, আর কাপড় ঘুচে গেল।