সে তো নিশ্চয়। অনামিকা দেবী নম্র গলায় বলেন, দেখি আপনাদের আবেদনপত্রের খসড়া।
ব্যাগ খুলে সন্তর্পণে বার করেন ভদ্রলোক।
জোরালো গলায় বলেন, দেশের এই দুর্দিনে আপনাদের উদাস থাকলে চলবে না অনামিকা দেবী। অন্ধকারে পথ দেখাবে কে? কল্যাণের বাতি জ্বেলে ধরবে কে? যুগে যুগে কালে কালে দুর্নীতিগ্রন্ত সমাজকে পঙ্কশয্যা থেকে আবার টেনে তুলেছে সাহিত্য আর শিল্প।
অনামিকা দেবী মৃদু হেসে বলেন, তাই কি ঠিক?
ঠিক নয়? বলেন কি?
তাহলে তো সম্ভবামি যুগে যুগে কথাটার অর্থই হয় না— বলে মৃদু হেসে কাগজটায় চোখ বুলোন অনামিকা দেবী।
ভাষা সেই একই। যা ভদ্রলোকরা আবেগদীপ্ত গলায় বলছেন।
দেশ পাপপঙ্কে নিমজ্জিত, মানুষের মধ্যে আর আদর্শ নেই, বিশ্বাস নেই, শ্রদ্ধা নেই, প্ৰেম নেই, পরার্থপরতা নেই, মানবিকতা বোধ নেই, সর্বস্ব হারিয়ে মানুষ ধ্বংসের পথে চলেছে। কিন্তু চলেছে বলেই কি চলতে দিতে হবে? বাঁধ দিতে হবে না?
অনামিকা দেবী মনে মনে হাসলেন। ভাবলেন আমার একটি স্বাক্ষরেই যদি এতগুলো নেই হয়ে যাওয়া দামী বস্তুকে ফিরিয়ে আনার সাহায্য হয় তো দেব বৈকি সেটা।
তবে বিশ্বাস জিনিসটা যে সত্যিই বড় বেশী চলে গেছে তাতে আর সন্দেহ কি? নচেৎ তোমাদের এই সব মহৎ চিন্তা আর মহৎ কথাগুলির মধ্যে কোনো আশার রস পাচ্ছি না কেন? কেন মনে হচ্ছে, কেবলমাত্র দুর্নীতিগ্রন্ত মানুষকে শুভবুদ্ধির শুভ্ৰ আলোক দেখাবার ব্ৰত নিয়েই তোমরা এই দুপুর রোদে গলদঘর্ম হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ, এ কি আর সত্যি? এটা বোধ হয় তোমাদের কোনো মতলবগ্রন্থের সুচারু মলাট!
তারপর ভাবলেন, মলাট নিয়েই তো কারবার আমাদের। এই যে সাহিত্য নিয়ে এত গালভরা কথা, সে-সাহিত্যও বিকোয় তো মলাটের জোরে। যার গেট আপ যতো জমকালো তার ততো বিক্রী।
কলামটা তুলে নিয়ে বসিয়ে দিলেন স্বাক্ষর।
ওঁরা প্ৰসন্ন মুখে ফিরে গেলেন।
অনামিকা দেবী তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ সেই চলে যাওয়া পথের দিকে। তারপর ভাবলেন, মতলবী যদি না হও তো তোমরা অবোধ। তাই চোরাকারবারীর শুভবুদ্ধির দরজায় হাত পাততে বসেছ।
যাক, যাইহোক, উদ্দেশ্যসিদ্ধির খুশি দেখা গেল ওদের মুখে। সেদিন দেখা যায়নি তাদের, সেই আর এক মানবকল্যাণ-ব্রতীদের।
.
তিন-চারটি রোগা রোগা কালো কালো ছেলে আর একটি মেয়ে এসেছিল সেদিন এই একই ব্যাপারে।
আবেদনপত্রে স্বাক্ষর!
তাদের চিন্তা শুধু দেশের গন্ডীতেই সীমাবদ্ধ নয়, সমগ্ৰ বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা তাদের। এই যুদ্ধোন্মাদ পৃথিবীকে শান্তির মন্ত্র দেবার জন্য স্বাক্ষর সংগ্রহ করে বেড়াচ্ছে তারা।
অনামিকা দেবী বলেছিলেন, আমার মনে হয় না যে এই পদ্ধতিতে সত্যকার কাজ হবে।
ওরা ক্ষুব্ধ হয়নি, আহত হয়নি, ফোঁস করে উঠেছিল।
বলেছিল, তবে কিসে সত্যকার কাজ হতে পারে বলে মনে হয় আপনার?
অনামিকা দেবী হেসে উঠেছিলেন, আমার এমন কি বুদ্ধি যে চট করে একটা অভিমত দিই! তবে মনে হচ্ছিল উন্মাদের কাছে শান্তির আবেদনপত্রের মূল্য কি?
ওরা যুক্তি ছেড়ে ক্রোধের শরণ নিয়েছিল। বলেছিল, তাহলে আপনি যুদ্ধই চান? শান্তি চান না?
তারপর দুএকটা বাক্য বিনিময়ের পরই, আচ্ছা ঠিক আছে। সই দেওয়া না দেওয়া আপনার ইচ্ছে। তবে এই থেকে আপনাদের সাহিত্যিকদের মনোভাব বোঝা যাচ্ছে। বলে ঠিকরে বেরিয়ে গিয়েছিল।
শান্তির জন্য দরজায় দরজায় আবেদন করে বেড়াচ্ছে ওরা, কিন্তু সহিষ্ণুতা শব্দটার বানান ভুলে গেছে।
সেদিন তারা রাগ করে চলে গিয়েছিল।
অনামিকা দেবী অস্বস্তি বোধ করেছিলেন।
আজ আর অস্বস্তি নেই। আজ এরা প্ৰসন্ন মুখে বিদায় নিয়েছেন। স্বস্তি কেনবার এই উপায়!
অন্যের বাসনা চরিতার্থের উপকরণ হও, অন্যের মতলবের শিকার হও, আর তাদের ওই উপরের মলাটটা দেখেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হও। ভিতর পৃষ্ঠায় কী আছে তা বুঝতে পেরেছ, একথা বুঝতে দিও না। ব্যাস, পাবে স্বস্তি। নচেৎ বিপদ, নচেৎ দুঃখের আশঙ্কা।
বাইরে এখনো রোদ ঝাঁ ঝাঁ করছে, গরমের দুপুর কেটেও কাটে না। কত কাজ জমানো রয়েছে, কত তাগাদার পাহাড় গড়ে উঠছে, তবু এই সময়টাকে যেন কাজে লাগানো যাচ্ছে না। সেজদিকে কি চিঠি লিখবেন এখন?
সেজদির চন্দননগরের সেই গঙ্গার ধারের বাড়িটা মনে পড়লো। অমলবাবু সেজদির জীবনে আর কোন সঞ্চয় রেখে গেছেন কিনা জানা নেই, তবু স্বীকার না করে উপায় নেই, এই এক পরম সঞ্চয় রেখে গেছেন তিনি সেজদির জীবনে। গঙ্গার ধারের সেই ছোট্ট বাড়িটি।
সেখানে একা থাকে সেজদি।
শুধু নিজেকে নিয়ে।
দুই-কৃতী ছেলে থাকে নিজ নিজ কাজের জায়গায়। তাদের মন্ত কোয়ার্টার, মন্ত বাগান, আরাম আয়েস স্বাচ্ছন্দ্য।
কিন্তু সেজদিকে সেখানে ধরে না।
সেজদির চাই আরো অনেকখানি আকাশ, আরো অনেকখানি বাতাস। তাই গঙ্গার ধারের বারান্দা দরকার তার।
তবু সেজদি লেখে-এখানে বাতাস নেই।
বাতাসের যোগানদার তবে কে?
০৩. শম্পা সেজেগুজে আনন্দে ছলছল
শম্পা সেজেগুজে আনন্দে ছলছল করতে করতে এসে দাঁড়ালো, সিনেমা যাচ্ছি পিসি। মাৰ্ভেলাস একখানা বই এসেছে লাইটহাউসে। যাচ্ছি, বুঝলে? দেরি হয়ে গেল সাজতে। সেই হতভাগা ছেলেটা টিকিট নিয়ে হাঁ করে বসে আছে তীর্থের কাকের মত, আর বোধ হয় একশো শাপমন্যি দিচ্ছে! চললাম। মাকে বলে দিও, বুঝলে?