সেই অন্য কোনো খানটা কি আছে এখনো অনামিকা দেবীর?
.
তিনতলা থেকে নেমে এলেন অনামিকা দেবী। কারা দেন দেখা করবার জন্যে অপেক্ষা করছে।
এমন অবস্থা সারাদিনে অনেকবার ঘটে, তিনতলা থেকে নেমে নেমে আসতে হয়। মেজদা বলে, তার থেকে বাবা তুই নীচের তলায় একটা ঘরেই পড়ে থাক। এতবার সিঁড়ি ভাঙার চেয়ে ভাল।
ভালবেসেই বলে, অন্য কোনো মতলবে নয়। তিনতলার লোভনীয় ঘরখানা বোন আগলে রেখেছে বলে কৌশলে তাকে নীচে নামাতে চাইবে, এমন নীচ ভাবা উচিত নয় দাদাদের। এটা ঠিক বাবার উইলের অধিকারেই আছেন তিনি, তথাপি দাদারা তেমন হলে টিকতে পারা সম্ভব ছিল কি?
না, অনামিকার প্রতি কোনো দুর্ব্যবহার হয় না। এই যে রাতদিন বাড়িতে লোকজন আসছে, এই যে যখন তখন মহিলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন, বৌদিরা তাকে কিছু বলতে আসেন?
না। অনামিকা দেবীকে কেউ কিছু শোনাতে আসেন না। যে যা শোনান নিজ নিজ স্বামীপুত্রকে অথবা ভগবানের বাতাসকে।
বড় তরফের অবশ্য দাদা বেঁচে নেই, আর বড় বৌদি থেকেও নেই, তবে বড়র অংশটুকু আগলে বাস করছে তার ছেলে অপূর্ব। আছে, তবে অপূর্ব তার স্ত্রী-কন্যা নিয়ে বাড়ির মধ্যেই আলাদা।
অপুর্বর স্ত্রীর রুচিপছন্দ শৌখিন, মেয়েকে আধুনিক স্টাইলে মানুষ করতে চায়, খুড়শাশুড়ীদের সঙ্গে ভেড়ার গোয়ালে থাকতে রাজী নয় সে। তাই বাড়ির মধ্যেই কাঠের স্ক্রীন দিয়ে নিজের বিভাগ ভাগ করে নিয়েছে অপূর্ব।
দোতলার দক্ষিণের বারান্দাটা অপূর্বর ভাগে। বারান্দাটাকে অবশ্য আর বারান্দা রাখেনি অপূর্ব, কাঁচের জানলা আর গ্ৰীল বসিয়ে সুন্দর একখানি হল-এ পরিণত করে ফেলেছে। সেখানে তার খাবার টেবিল আর বসবার সোফাসেট দুভাগে সাজানো।
অপুর্বর স্ত্রী অলকার মাথাটা চমৎকার। তার মাথা থেকেই তো বেরিয়েছে এসব পরিকল্পনা। তা নইলে এই চিরকেলে সনাতনী বাড়িটি তো সেই সনাতন ধারাতেই চলে আসছিল।
সেই মাটিতে আসন পেতে খাওয়া, সেই মাটিতে সরঞ্জাম ছড়িয়ে এলোমেলো করে চা বানানো, কোথাও কোনো সৌকুমার্যের বালাই ছিল না।
বাড়িখানা নেহাৎ ছোট নয়, কিন্তু সবটাই কেমন একাকার। ফ্ল্যাটবাড়ির স্টাইল নেই কোনোখানে; ভাই বাড়ি থেকে কোনো আয়ের উপায়ও নেই। ভবিষ্যৎবুদ্ধি ছিল না আর কি বাড়ি-বানানেওয়ালার!
এসব দেখেশুনে অলকা হতাশ হয়ে নিজের এলাকাটুকু নিজের মনের মত করে সাজিয়ে নিয়েছে। তার মেয়ে অভিজাতদের স্কুলে পড়ে, তার চাকর বুশ শার্ট আয় পায়জামা পরে, চটি পায়ে রাঁধে।
অনামিকা দেবীর মেজ বৌদি আর সেজ বৌদি প্রথম দিকে ভাসুরপো-বৌয়ের অনেক সমালোচনা করেছিলেন, অনেক বিদ্রুপের ফুলঝুরি ছড়িয়েছিলেন, কিন্তু ক্রমশঃ নিজেরাই ওই আধুনিকতার সুবিধেগুলো অনুধাবন করেছেন এবং কখন অলক্ষ্যে সেগুলির প্রবর্তনও করেছেন। এখন ওরা পুরুষদের অন্ততঃ টেবিলে খেতে দেওয়াটা বেশ ভালো মনে করেন।
অনামিকা দেবী অবশ্য এসবের মধ্যে ঢোকেন না কখনো। না মন্তব্য, না মতপ্রকাশে। আজীবনের এই জায়গাটায় তিনি যেন আজীবনই অতিথি।
অতিথির সৌজন্য, অতিথির কুণ্ঠা এবং অতিথির নির্লিপ্ততা নিয়েই বিরাজিত তিনি।
.
নীচে নেমে এসে দেখলেন, জনা তিন-চার বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভদ্রলোক। অনামিকাকে দেখে সসম্ভ্রমে নমস্কার করলেন। প্রতি-নমস্কারের পালা চুকলো। তারপর কাজের কথায় এলেন তারা।
একটি আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করাতে এসেছেন। দেশের সমন্ত মান্যগণ্য, বিশিষ্ট চিন্তাবিদ শিক্ষাবিদ সমাজকল্যাণী আর শুভবুদ্ধি-সম্পন্নদের স্বাক্ষর সংগ্ৰহ করতে নেমেছেন তারা। অনামিকা দেবীকেও ফেলেছেন সেই দলে।
কিন্তু আবেদনটা কিসের?
আবেদনটা হচ্ছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে।
এই দুর্নীতিসাগরে নিমজ্জিত দেশের অন্ধকার ভবিষ্যৎ দেখে বিচলিত বিপর্যন্ত এরা সে সাগরে বাঁধ দিতে নেমেছেন।
ওজস্বিনী ভাষায় এবং বিক্ষুব্ধ গলায় বলেন তারা, ভাবতে পারেন কোথায় আজ নেমে গেছে দেশ? খাদ্যে ভেজাল দিচ্ছে, ওষুধে ভেজাল দিচ্ছে, শিক্ষা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে–
এমন ভাবে বলেন, যেন এইমাত্র টের পেয়েছেন তারা দেশে এইসব ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটছে!
অনামিকা দেবী মনে মনে বলেন, খোকাবাবুরা এইমাত্ৰ বুঝি স্বৰ্গ হতে টসকে পড়েছ! এ মর্ত্যভূমে বিধাতার হাত ফসকে? কিন্তু সে তো মনে।
মুখে শান্ত সৌজন্যের পালিশে ঈষৎ দুঃখের নক্সা কেটে বলেন, সে তো করছেই।
করছেই বলে তো চুপ করে থাকলে চলবে না অনামিকা দেবী। সমাজের দুর্নীতিতে আপনাদের দায়িত্ব সর্বাধিক। শিল্পী-সাহিত্যিকরা যদি দায়িত্ব এড়িয়ে আপন উচ্চমানসের গজদন্তমিনারে বসে শুধু কল্পনার স্বৰ্গ গড়েন, তাহলে সেটা হবে দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা।
অনামিকা দেবী চমকিত হন।
না, ভয়ঙ্কর নতুন এই কথাটায় নয়, ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বরে। ওঁর মনে হয় বাড়ির লোকেরা শুনলে ভাববে, কেউ আমাকে ধমক দিতে এসেছে।
চমকিত হলেও শান্ত স্বরেই বলেন, কিন্তু আবেদনটা কার কাছে?
কার কাছে?
ভদ্রলোক উদ্দীপ্ত হন, মানুষের শুভবুদ্ধির কাছে।
মানুষ? মানে ওই সব ভেজালদার চোরাকারবারীদের কাছে?
খুব আস্তে, খুব নরম করেই কথাটা বললেন অনামিকা দেবী, ভদ্রলোকরা যেন আহত হলেন, আর সেটা অপ্রকাশও রাখলেন না। ক্ষুব্ধ গলাতেই বললেন, আপনি হয়তো আমাদের প্রচেষ্টাকে লঘুচক্ষে দেখছেন, কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, মানুষের শুভবুদ্ধি কোনো সময় না কোনো সময় জাগ্রত হয়।