কিন্তু বক্তব্যটা শেষ করলে বুঝি অনামিকার মনের মধ্যে এমন একটা কণ্টক প্রবেশ করিয়ে দিয়ে রাখতে পারতো না সেজদি।
অনামিকা চিঠিটা শেষ করে তার সেই অশেষ বাণীটি চিন্তা করতে লাগলেন।
বকুলের খাতার কি হল?
অনামিকা দেবী কি সেটা হারিয়েই ফেলেছেন? না সত্যিই অবহেলায় ঔদাসীন্যে পোকায় কাটিয়ে শেষ করেছেন?
কোথায় সেই খাতা?
অনামিকা কি খুঁজতে বসবেন?
.
কিন্তু সেই অনেকদিনের আগের অনাদৃত খাতাটা খোঁজবার সময় কোথায় অনামিকার? আজই একটা সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে উত্তরবঙ্গে যেতে হচ্ছে না তাকে? গোটাতিনেক দিন সেখানে যাবে, তারপর ফিরে এসেই ওই বাণীনগর বিদ্যামন্দির, তার পরদিন বিশ্বনারী প্ৰগতি সংঘ, দুর্গার পরদিন যুব উৎসব, তারপর পর পর তিন দিন কোথায় কোথায় যেন। ডায়েরি খাতা দেখতে হবে।
বকুলের খাতা তবে কখন খোঁজা হবে? ধুলোর ন্তর সরিয়ে কখন খুলে দেখা হবে? দিন যাচ্ছে ঝড়ের মত, সেই ঝড়ের ধুলো গিয়ে জমছে সমন্ত পুরনোর উপর, সমন্ত তুলে রাখা সঞ্চয়ের উপর।
সেজদির সেই এখানে বাতাস নেই নামের কবিতায় লেখা চিঠিটার কথা মনে পড়লো। বরের উপর, অথবা জীবনের উপরই অভিমান করে সেজদি একদা কবিতা লেখা বন্ধ কয়ে দিয়েছিল। প্রেমের কবিতা আর লিখতে না।
সেজদির বর অমলবাবুর ধারণা ছিল, ভিতরে ভিতরে একটি প্রণয়কাণ্ড আর গোপন কোনো প্ৰেমাস্পদ না থাকলে এমন গভীর প্রেমের কবিতা লেখা সম্ভব নয়।
আদি অনন্তকালের সমন্ত মানুষের মধ্যেই যে অল্প বিন্তর একটি প্রণয়কাণ্ড থাকে, আর চিরন্তন এক প্ৰেমাস্পদও অবিনশ্বর মহিমায় বিরাজিত থাকে, হৃদয়ের সমন্ত আকূতি সেখানে গিয়েই আছাড় খায়, একথা বোঝবার মনটা ছিল না অমলবাবুর।
তাই অমলবাবু তার আপন হৃদয়ের অধীশ্বরীর হৃদয়ের উপর কড়া নজর রাখতেন, সে হৃদয়ের জানলা দরজার খিল ছিটিকিনি যেন কোনো সময় খোলা না থাকে। যেন বাইরের ধুলো জঞ্জাল এসে ঢুকে না পড়ে, অথবা ভিতরটাই ফসকে বেরিয়ে না পালায় কোনো ফাঁক দিয়ে।
খিলছিটিকিনিগুলো তাই নিজের হাতে বন্ধ করতে চেষ্টা করতেন।
সেজদিও চোরের উপর রাগ করে মাটিতে ভাত খেয়েছিল। সেজদি প্রেমের কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছিল। তারপর তো–
হ্যাঁ, তারপর তো অমলবাবু মারাই গেলেন।
.
কিন্তু তারপর সেই নিঃসঙ্গতার ভূমিতেও আর গভীর গভীর প্রেমের কবিতা লেখেনি সেজদি, বরং তলিয়ে গেছে আরো গভীরে। সেখানে বুদ্বুদ ওঠে না। অথবা হৃদয় নামক বস্তুটা একতলার ঘরটা থেকে উঠে গেছে। মস্তিষ্কের চিলেকোঠায়।
নামকরা লেখিকা অনামিকা দেবীও বলেন, তোর কবিতা এখন আর পড়ে বুঝতে পারিনে বাবা!
দেখা-সাক্ষাৎ প্ৰায় নেই, সেজদি জীবনে আর বাপের বাড়ি আসবো না প্ৰতিজ্ঞা নিয়ে বসে আছে দূরে, অথচ অনামিকা দেবীর সেই বাপের বাড়িটাই একমাত্র ভরসা। অনামিকার নিজের কোন বাড়ি নেই। সেজদির কাছে তাই কদাচ কখনো নিজেই যান। তা সে কদাচই-চিঠির মধ্যেই সব। নতুন কবিতা লিখলে লিখে পাঠায় সেজদি। মন্তব্য পাঠান অনামিকা দেবী।
তবে আবার মাঝে মাঝে খুব সরল ভাষায় আর সাদাসিধে ছন্দে কবিতায় চিঠি লেখে সেজদি, অনামিকাকে আর তার সেই ছোট্ট বন্ধু মোহনকে। অসমবয়সীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করবার আশ্চর্য একটা ক্ষমতা আছে সেজদির। আর সেই অসমরাও দিব্যি সহজে নির্দ্বিধায় সেজদির সঙ্গে সমান হয়ে গিয়ে মিশে যায়।
এ ক্ষমতা সকলের থাকে না, এ ক্ষমতা দুর্লভ। শিশুর বন্ধু হতে পারার ক্ষমতাটা ঈশ্বরপ্রদত্ত।
একদা নাকি সেজদিদের পাশের বাড়ির বাসিন্দা ছিল মোহনরা। অর্থাৎ তার মা বাবা। অবাঙালী সেই ভদ্রলোকদের সঙ্গে সেজদিদের পরিচয় স্বল্পই ছিল, কিন্তু তাদের বছর চারপাঁচের ছেলেটা সেজদির কাছেই পড়ে থাকতো। সেজদির সঙ্গে গল্প করে করে বাংলায় পোক্ত হয়ে গিয়েছিল সে।
কবেই তারা অন্যত্র চলে গেছে, মোহন স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে হয়তো কলেজেই উঠে গেছে এখন, তবু আন্টির সঙ্গে সম্পর্কটা রেখেছে বজায়।
সেজদিকে নাকি তাকে মাঝে মাঝে ছন্দবদ্ধে পত্র লিখতে হয় সেই তার ছেলেবেলার মত। সেও নাকি আজকাল বাংলা কবিতায় হাত মকশ করছে। আর সেটা সেজদির উপর দিয়েই। অতএব ওটা চলে।
আর চলে অনামিকা দেবীর সঙ্গে।
এখানে বাতাস নেই লিখেছিল কবে যেন। একটু একটু মনে পড়ছে–
এখানে বাতাস নেই, দিন রাত্রি স্তব্ধ হয়ে থাকে
ওখানে উন্মত্ত ঝড় তোমারে আচ্ছন্ন করে রাখে।
তোমার কাজের ডানা অবিশ্রাম পাখা ঝাপটায়,
আমার বিশ্রাম সুখ সময়ের সমুদ্রে হারায়।
এখানে বাতাস নেই, দেয়ালের ক্যালেণ্ডার চুপ,
তোমার তারিখ পত্র ঝড়ে উড়ে পড়ে ঝুপঝুপ।
ঘন্টামিনিটেরা যেন—
নাঃ, আর মনে পড়ছে না। আরো অনেকগুলো লাইন ছিল। অনামিকা দেবী সেই তুলনামূলক ভঙ্গীতে লেখা কবিতাপত্র পড়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন সেজদির সঙ্গে আমার কতদিন দেখা নেই, সেজদি আমার এই ঝড়টা তো চোখেও দেখেনি, তবু এত পরিষ্কার বুঝলো কি করে? শুধু নিজের বিপরীতে দেখে?
অথচ এই ঝড়ের গতিবেগটা সৰ্ব্বদা যারা দেখে, তারা তো তাকিয়েও দেখে না। বরং বলে, বেশ আছো বাবা! দিব্যি টেবিল চেয়ারে বসে বানিয়ে বানিয়ে যা ইচ্ছে লেখো, আর তার বদলে মোটা মোটা চেক–
যাক গে, থাক তাদের কথা, বকুলের খাতটা খুঁজতে হবে। কিন্তু কোথায় সেই খোঁজার ঠাঁইটা? বাক্স? আলমারি? পুরনো সিন্দুক? না আরো অন্য কোনোখানে?