ডেকে দিলেন।
শম্পা উঠে এল।
বললে, বাবাঃ, তোমার এই তিনতলায় উঠতে উঠতে গেলাম! কই দেখি আবার কে বকবকাতে ডাকছে!…এই নাও, নীচে তোমার একটা চিঠি এসেছিল—
টেবিলের ওপর খামের চিঠিটা রেখে পিসির দিকে পিঠ আর দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়ালো শম্পা রিসিভারটায় কান–মুখ চেপে।
অনামিকা দেবী খামের মুখটা না খুলেই হাতে ধরে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। সেজাদির চিঠি।
অনেক দিন পরে এসেছে। সেজদি আর চিঠিপত্র লেখে না।
কিন্তু অনামিকাই বা কত চিঠি দিচ্ছেন! শেষ কবে দিয়েছেন মনেও পড়ে না। অথচ কত চিঠিই লিখে চলেছেন প্রতিদিন রাশি রাশি। আজেবাজে লোককে। সেজদি বড় অভিমানী। কাজে সারা চিঠি চায় না সে।
০২. সেজদি বড় অভিমানী
সেজদি বড় অভিমানী।
সে অভিমানের মূল্যও আছে অনামিকা দেবীর কাছে। অনেকখানি আছে। তবু সেজদির চিঠির উত্তর দেওয়া হয়ে ওঠে না। নিজে থেকেও একখানা চিঠি সেজদিকে দেওয়া হয়ে ওঠে কই! অথচ সেই না হয়ে ওঠার কাঁটাটা ফুটে থাকে মনের মধ্যে। আর সেই কাঁটা ফোটা মন নিয়েই হয়তো অন্য সাতখানা চিঠি লিখে ফেলেন। মানে লিখতে হয়।
বাংলা দেশের অসংখ্য পাঠক-পাঠিকা অনামিকা দেবীর লেখা ভালবাসে, তাই অনামিকা দেবীকেও ভালবাসে, সেই ভালবাসার একটা প্ৰকাশ চিঠি লিখে উত্তর পাবার প্রার্থনায়। সেই প্রার্থনায় থাকে কত বিনয়, কত আবেগ, কত সংশয়, কত আকুলতা!
অনামিকা দেবী তাদের বঞ্চিত করবেন?
তাদের সেই সংশয় ভঞ্জন করবেন না?
সামান্য একখানি চিঠি বৈ তো নয়!
চিঠিও নয়, চিঠির উত্তর।! কিঞ্চিৎ ভদ্রতা, কিঞ্চিৎ মমতা, কিঞ্চিৎ আন্তরিকতা, মাত্র এইটুকু। সেটুকু দিতে না পারলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন কি করে অনামিকা দেবী? তাছাড়া তাদের কাছেই বা অনামিকা দেবীর মূর্তিটা কোন ভাবে প্রকাশিত হবে?
হয়তো ওই কয়েক ছত্র লেখার অভাবে তাদের ক্যামেরায় অনামিকা দেবীর চেহারাটা হয়ে দাঁড়াবে উন্নাসিক অহঙ্কারী অভদ্র!
অনামিকা দেবী তা চান না।
অনামিকা দেবী নিজের বাইরের চেহারাটা ভিতরের মতই রাখতে চান। সামান্য অসতর্কতায়, ঈষৎ অবহেলায় তাতে ধুলো পড়তে দিতে চান না। এছাড়া প্রয়োজনীয় চিঠিপত্রের সংখ্যাও তো কম নয়? গতানুগতিক সাধারণ জীবনের বাইরে অন্য কোনো জীবনের মধ্যে এসে পড়লেই তার একটা আলাদা দায়িত্ব আছে।
সে সব দায়িত্ব সম্ভবমত পালন করতেই হয়। অস্তুতঃ তার চেষ্টাটাও করতে হয়। ব্যবহারটা যেন ত্রুটিহীন হয়।
অতএব কিছুই হয় না। শুধু একান্ত প্রিয়জনের ক্ষেত্রে।
সেখানে ত্রুটির পাহাড়।
সেখানে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ভারী হয়ে ওঠে অপরাধের বোঝা। তবু ‘হয়ে ওঠে না’।
কিন্তু কারণটা কি? ওই সাতখানার সঙ্গে আর একখানা যোগ করা কি এতই অসম্ভব?
হয়তো অসম্ভব নয়। কিন্তু আবার অসম্ভবও। প্রিয়জনের পত্র দায়সারা করে লেখা যায় না। অস্তুতঃ অনামিকা দেবী পারেন না। অনামিকা দেবী তার জন্যে চান একটুকরো নিভৃতি। একমুঠো অবকাশ। ‘অনামিকা দেবী’র খোলসের মধ্যে থেকে নিজেকে বার করে এনে খোলা মনের ছাদে এসে বসা।
কিন্তু কোথায় সেই নিভৃতি?
কোথায় সেই অবকাণ?
কোথায় সেই নিজেকে একান্তে নিয়ে বসবার খোলা ছাদ?
নেই। মাসের পর মাস সে অবস্থা অনুপস্থিত।
তাই ত্রুটির পাহাড় জমে। তাই প্রিয়জনের খামের চিঠি খোলার আগে বুকটা দুরু দুরু করে। মনে হয় খোলার সঙ্গে সঙ্গে ওর মধ্যে থেকে টুক করে যেটুকু খসে পড়বে, সে হচ্ছে একখণ্ড উদাসীন অভিমান।
কিন্তু প্রিয়জনের সংখ্যা অনামিকা দেবীর কত?
.
খামখানা খোলার আগে তার উপর মৃদু একটু হাত বোলালেন অনামিকা। যেন সেজদির অভিমানের আবরণটুকু মুছে ফেলতে চাইলেন, তারপর আস্তে খামের মুখটা খুললেন।
আর সেই সময় টেলিফোনটা আবার ঝনঝনিয়ে উঠলো।
অনামিকা দেবী আছেন?
কথা বলছি।
শুনুন আমি বাণীনগর বিদ্যামন্দির থেকে বলছি—
বললেন তিনি তাঁর বক্তব্য। অনামিকা দেবীর কথায় কানমাত্র না দিয়ে জোরালো গলায় যা জানালেন তা হচ্ছে, এই উচ্চ আদর্শপূত বিদ্যামন্দিরের পারিতোষিক বিতরণ উৎসবে ইতিপূর্বে অনেক মহা মহা ব্যক্তি এসে গেছেন, এবার অতঃপর অনামিকা দেবীর পালা।
অতএব ধরে নিতে হয় এই সূত্রে অনামিকা দেবী মহামহাদের তালিকায় উঠলেন। অথবা ইতিপূর্বে উঠেই বসেছিলেন, শুধু পালাটা আসতে বাকি ছিল।
অনামিকা দেবীর ক্ষীণ প্রতিবাদ মৃদু আপত্তি বানের জলে ভেসে গেল। ওপিঠ থেকে সবল ঘোষণা এল, কার্ড ছাপতে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
.
সেজদির চিঠিটা অনেকক্ষণ আর পড়তে ইচ্ছে হল না। যেন একটা কোমল সুরের রেশের উপর কে তবলা পিটিয়ে গেল।
তারপর খুলে পড়লেন।
সেজদি লিখেছে–
অনেক তো লিখেছে। কাগজ খুললেই অনামিকা দেবী, কিন্তু সেটার কি হল? সেই বকুলের খাতাটার?
খাতাখানা পোকায় কেটে শেষ করেছে? নাকি হারিয়ে গেছে? কিন্তু—
কিন্তু বলে ছেড়ে দিয়েছ। সেজদি।
আর কোনো কথা লেখেনি।
শুধু তলায় নাম সই—সেজদি।
চিঠি লেখার ধরনটা সেজদির বরাবরই এই রকম। চিঠির রীতিনীতি সম্পর্কে মোটেই নিষ্ঠা নেই তার। বাড়ির যাকেই চিঠি দাও, বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের যথাবিহিত সম্মান ও আশীৰ্ব্বাদ জানানো যে একান্ত অবশ্যক, চিঠিটা যে প্রধানত কুশল বিনিময়ের উদ্দেশ্যে, আর পরিচিত জগতের সব কিছু খবরের আদান-প্ৰদানটাই যে আসল প্রসঙ্গ হওয়া সঙ্গত, এ বোধ নেই সেজদির। চিঠিতে সেজদি হঠাৎ যেন কথা কয়ে ওঠে। আর কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যাওয়াটা যেমন স্বভাব তারা, তেমনিই হঠাৎ থেমে যায়। তাই কিন্তু বলে থেমে গেছে।