এটা বেশ কিছুদিন চাপা ছিল, উদ্ঘাটিত হলো একদিন পাড়ার আর একটি ছেলের দ্বারা। হয়তো নিজে সে প্রার্থী ছিল, তাই বলে দিয়ে আক্রোশ মেটালো।
খবরটা বাড়িতে জানাজানির পর দিনকতক শম্পার গতিবিধির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হলো, শম্পার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে এনে দেওয়ার ভার নিলো তার বাবা। কিন্তু প্রয়োজন তো শম্পার জিনিসের নয়, প্রেমের।
অতএব কিছুদিন মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়ালো শম্পা, তারপর আবার নতুন গাছে বাসা বাঁধলো। এবারে এক সহপাঠিনীর দাদা।
এ খবরটা বাড়িতে এসে পৌঁছবার কথা নয়। কারণ সহপাঠিনী সহায়িকা। সে তার বান্ধবীকে এবং দাদাকে আগলে বেড়াতে যত রকম বুদ্ধিকৌশল প্রয়োগ করা সম্ভব তা করতে ত্রুটি করেনি।
কিন্তু খবরটা তথাপি এলো।
এলো অনামিকা দেবীর কাছে।
প্ৰণয়ভঙ্গের পর।
শম্পা নিজেই তার লেখিকা পিসির কাছে বাক্ত করে বসলো। কারণ শম্পার তখন বয়স বেড়েছে, সাহস বেড়েছে। একদিন অনামিকা দেবীর এই তিনতলার ঘরে এসে বললো, পিসি, একটা গল্পের প্লট নেবে?
তারপর সে দিব্যি একখানি প্ৰেমকাহিনী ব্যক্তি করার পর প্রকাশ করলো প্লটের নায়িকা সে নিজেই। এবং স্বচ্ছন্দ গতিতে সব কিছু বলার পর হেসে কুটিকুটি হয়ে বলতে লাগলো, বল তো পিসি, এরকম বুদ্ধমার্কা ছেলের সঙ্গে কখনো প্রেম চালানো যায়? না তাকে সহ্য করা যায়?
অনামিকার নিজের গল্পের অনেক নায়িকাই দুঃসাহসিকা বেপরোয়া, মুখরা প্রখরা। তথাপি অনামিকা তার নিজের দাদার মেয়ে, নিজের বাবার নাতনীর এই স্বচ্ছন্দ বাকভঙ্গীর দিকে তাকিয়ে রইলেন অভিভূত দৃষ্টি মেলে।
শম্পা বললো, লিলি তো আমার ওপর মহা খাপপা, ওর দাদার নাকি অপমান হয়েছে।
তা সেটাই স্বাভাবিক।
বলেছিলেন অনামিকা দেবী।
শম্পা হেসে হেসে বলেছিল, তা কি করা যাবে? উনিশ বছর এখনো পার হয়নি, সবে থার্ড ইয়ারে ঢুকেছে, বলে কি না তোমার পিসিকে বলে–কয়ে—হি হি হি,—বিয়ের কথাটা পাড়াও!
অনামিকা দেবী মৃদু হেসে বলেছিলেন, তা তুমিও তো এখনো স্কুলের গণ্ডি ছাড়াওনি, সবে পনেরো বছরে পা দিয়েছ—
তা আমি কি, হি হি, বিয়ের চিন্তা করতে বসেছি?
প্রেম করছো!
শম্পা লেশমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে বলেছিল, সে আলাদা কথা। ওটা হচ্ছে একটা চার্ম। একটা থ্রিলও বলতে পারো। তা বলে বিয়ে? হি হি হি!
তা সেই বুদ্ধুটাকে ত্যাগ করার পর শম্পা অন্ততঃ মন–মরা হয়ে বেড়ালো না। সাঁতার ক্লাবে ভর্তি হলো, আবদার করে সেতার কেনালো।
মা পিসি বাপ ঠাকুমা সরাই ভাবলো, এটা মন্দ নয়, বেটা ছেলেদের সঙ্গে হৈ–চৈ করে বেড়ানোর থেকে ভাল। দাদা তখন নিজের ব্যাপারেই মগ্ন, একটা স্কলারশিপ যোগাড় করে বিলেত যাবার তাল করছে, তুচ্ছ একটা বোন আছে কিনা তাই মনে নেই। তাছাড়া শম্পার মাও মেয়ের ব্যাপারটা সাবধানে ছেলের জ্ঞানগোচর থেকে তফাতেই রাখতে চেষ্টা করতেন। যা কিছু শাসন চুপি চুপি।
কিন্তু শম্পা চার্ম চায়।
তাই শম্পা তাদের ওই সাঁতার ক্লাবের এক মাস্টার মশায়ের প্রেমে হাবুড়ুবু খেতে শুরু করলো। বোধ করি তিনিও এর সদ্ব্যবহার করতে লাগলেন।
সাঁতারের ঘণ্টা বেড়েই চলতে লাগল এবং বেড়ে চলতে লাগলো। শম্পার সাহস।
অতএব ক্রমশঃ মা বাবা শাসন করবার সাহস হারাতে লাগলো। দাদা তো তখন পাড়ি দিয়েছে সমুদ্রপারে। শম্পার বাড়ি আরো বেড়ে যায়। শম্পাকে এক কথা বললে,—একশো কথা শুনিয়ে দেয়, বাড়ি ফিরতে রাত হয়েছে বলে রাগারাগি করলে পরদিন আরো বেশী রাত্তির করে, বেরোতে হবে না বললে তৎক্ষণাৎ চটি পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে যায়। বলে, হারেমের যুগে বাস করছে নাকি তোমরা?
বাবা রাগ করে বললো, মরুকগে। যা খুশি করুকগে।
অনামিকা দেবী বললেন, ভালো দেখে একটা বর খোজো বাপু, সব ঠিক হয়ে যাবে। সময়ে বার না পেয়েই মেয়েগুলো আজকাল বর্বর হয়ে উঠছে। লেখিকার মতো নয়। অবশ্য কথাটা, নিতান্তই মাসি–পিসির মত কথা।
শম্পার মা কথাটা নস্যাৎ করলেন। বললেন, সবে ফাস্ট ইয়ারে পড়ছে, এক্ষুনি বিয়ে দিতে চাইলে লোকে বলবে কি? তাছাড়া কৃতী ছেলেই বা পাবো কোথায় বয়সের সঙ্গে মানানো? আমাদের আমলের মতো দশ–বারো বছরের বড় বর তো আর ধারে দিতে পারি না?
কি আর করা। তবে?
শম্পাই ছেলে ধরে বেড়াতে লাগলো। সাঁতারুকেও ত্যাগ করলো একদিন লোকটার কথাবার্তা বড় একঘেয়ে বলে।
তারপর কিছুদিন খুব উঠে পড়ে লেগে লেখাপড়া করলে শম্পা, মনে হলো এইবার বুঝি বুদ্ধি থিতিয়েছে।
কিন্তু নিজে মুখেই স্বীকার করে গেল একদিন শম্পা পিসির কাছে, একটা প্ৰেম–ট্রেম থাকবে না, কেউ আমার জন্যে হাঁ করে বসে থাকবে না, আমায় দেখলে ধন্য হবে না, এ ভালো লাগে না, বুঝলে পিসি? কিন্তু সত্যি প্রেমে পড়তে পারি এমন ছেলে দেখি না!
তা যখন সত্যি প্রেমের প্রশ্ন নেই, তখন আজেবাজেতেই শুধু চার্ম খুঁজলে বা ক্ষতি কি? সেই সময়টায় শম্পা একজন ক্যাবলী–মার্কা প্রফেসরের প্রেমে পড়লো।
প্রফেসারটি যদিও বিবাহিত।
কিন্তু তাতে কি? শম্পা বললে, আমি তো আর তাকে বিয়ে করতে চাইছি না! শুধু একটু ঘোল খাওয়ানো নিয়ে কথা।
সেই ঘোল খাওয়ানো পর্বটার পর কলেজ–লাইব্রেরীর লাইব্রেরীয়ান ছোকরার সঙ্গে কিছুদিন এখন শম্পার আর একটি চলছে।
অনামিকা আর একবার লেখায় মন দেবার চেষ্টা করেছিলেন, ফোনটা আবার বেজে উঠলো।
একটি তাজা সপ্রতিভ কণ্ঠ বলে উঠলো, শম্পাকে একটু ডেকে দিন তো।