হয়তো বা সংসারে নিজের মূল্য বজায় রাখতে। কেউ কিছু বলেনি, তবু বুঝি তখন থেকে নিজেকে তাঁর সংসারে অবান্তর বলে মনে হতো, তাই যখন তখন মর-মর হতেন।
সে যাক, নিজেকে অশক্ত বলে বলে অবশেষে তাই-ই হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। কথা বললেই কাসতে শুরু করতেন।
পারুল বলতো, ওটা নার্ভাসনেস, মিথ্যে কাসি কেসে শেষ অবধি—
কিন্তু পারুল তো অমন অনেক উদ্ভট কথা বলে। সেদিনও বাপের মুখের ওপর বলে উঠেছিল, আপনারা স্রেফ চোখ থাকতে অন্ধ। পাত্র তো আপনার চোখের সামনেই রয়েছে।
চোখের সামনেই পাত্র!
পারুলের বাবা আকাশ থেকে পড়েছিলেন, কার কথা বলছিস তুই?
কার কথা আবার বলবো বাবা? কেন-নির্মলের কথা মনে পড়লো না আপনার?
নির্মল! মানে অনুপমবাবুর ছেলে সুনির্মল?
অশক্ত মানুষটা সহসা শক্ত আর সোজা হয়ে উঠে বলেছিলেন, ওঃ, ওই হারামজাদি বুঝি উকিল খাড়া করেছে তোকে? নির্মলের বাড়ি যাওয়া বার করছি আমি ওর!
আর এখন যায়ও না। তাছাড়া আপনি তো জানেন। পরের শেখানো কথা কখনও কইনা আমি। আমি নিজেই বলছি-
নিজেই বলছো।
বাবা বিবাহিত মেয়ে এবং কৃতী জামাইয়ের মর্যাদা বিস্মরণ হয়ে খোঁকিয়ে ওঠেন, তা বলবে বৈকি! বাসায় গিয়েছ, আপটুডেট হয়েছ! বলি ওদের সঙ্গে আমাদের কাজ হয়?
এই খেঁকিয়ে ওঠাটা যদি পারুলের নিজের সম্পর্কে হতো, অবশ্যই পারুল আর দ্বিতীয় কথা বলতো না, কিন্তু পারুল এসেছিল বকুল সম্পর্কে একটা বিহিত করতে। তাই পারুল বলেছিল, হয় না কথাটার কোনো মানে নেই। হওয়ালেই হয়।
হওয়ালেই হয়?
তাছাড়া কি? নিয়ম-কানুনগুলো তো ভগবানের সৃষ্টি নয় যে তার নড়াচড় নেই! মানুষের গড়া নিয়ম মানুষেই ভাঙে।
বাঃ, বাঃ! বাপ আরো খোঁকিয়ে উঠেছিলেন, বাক্যি তো একবারে মা বসিয়ে দিয়েছে। তা বলি আমি ভাঙতে চাইলেই ভাঙবে? ওরা রাজী হবে?
যদি হয়?
হবে! বলেছে তোকে?
আমি বলছি যদি হয়, আপনি অরাজী হবেন না তো?
বাপ আবার অশক্ত হয়ে শুয়ে পড়ে বলেছিলেন, আমার আবার অরাজী। রোগা মড়া, একপাশে পড়ে আছি, মরে গেলে একদিন ছেলেরা টেনে ফেলে দেবে। মেয়ে যদি লভ করে কারুর সঙ্গে বেরিয়েও যায়, কিছু করতে পারবো আমি?
পারুল নির্নিমেষে তাকিয়ে ছিল ওই বুকে হাত দিয়ে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে নিঃশ্বাস ফেলা লোকটার দিকে। তারপর চলে এসেছিল।
চলে এসে ভেবেছিল, হালটা কি তবে আমিই ধরবো?
কিন্তু হাল ধরলেই কি নৌকো চলে? যদি বালির চড়ায় আটকে থাকা নৌকো হয়? তবু শেষ চেষ্টা করে যাব।
নাঃ, তবু বকুলের জীবন-তরণীকে ভাসিয়ে দিয়ে যেতে পারেনি। পারুল, শুধু সেবার চলে যাবার সময় বলে গিয়েছিল, তোর কাছে আমি অপরাধী বকুল, শুধু শুধু তোকে ছোট করলাম।…আশ্চর্য ভাবতেই পারিনি একটা মাটির পুতুলকে তুই-
রোষে ক্ষোভে চুপ করে গিয়েছিল পারুল।
.
কিন্তু বকুলের সেই কথাটার শেষটুকু শোনা হল না। সেই মৃদু হাসির উপর রূঢ় রুক্ষ কর্কশ একটা ধাক্কা এসে আছড়ে পড়লো।
ঘড়ির অ্যালাম!
নিয়মের বাড়িতে শেষ রাত্রি থেকে কৰ্মচক্ৰ চালু করার জন্যে ঘড়িতে অ্যালার্ম দেওয়া থাকে। ভারী লক্ষ্মী আর হুঁশিয়ার বৌ নমিতা। ওই অ্যালার্মের শব্দে উঠে পড়েই ও সেই চাকাটা ঘোরাতে শুরু করবে। শীতের দেশ, চাকরবাকররা ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতে চায় না, অথচ ভোর থেকেই বাড়ির সকলের বেড-টি চাই, গরম জল চাই।
এ কাজ নমিতাকে কেউ চাপিয়ে দেয়নি, নমিতা স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছে। আত্মপীড়নও এক ধরনের চিত্তবিলাস। এ বিলাস থাকে কারো কারো। কেউ না চাইলেও তারা ত্যাগস্বীকার করে, স্বাৰ্থত্যাগ করে, অপ্রয়োজনে পরিশ্রম করে অহেতুক সেবা করে।
নইলে অনামিকা দেবীর বন্ধ দরজায় করাঘাত করে বেড-টি বাড়িয়ে ধরবার দরকার ছিল না তার, অনামিকা দেবীর দায়িত্ব তার নয়।
অ্যালার্মের শব্দে চকিত হয়ে টেবিলে রাখা হাতঘড়িটা দেখেছিলেন অনামিকা দেবী, অবাক হয়ে ভাবছিলেন, আমি কি তবে ঘুমোইনি?
চায়ের পেয়ালা দেখে আরো অবাক হয়ে ভাবলেন, এ মেয়েটাও কি ঘুমোয়নি?
বললেন সেকথা।
নমিতা একটু উদার হাসি হাসলো, ঘুমিয়েছিলাম, উঠেছি। এই সময়ই উঠি আমি। ঘড়িতে অ্যালাম দিয়ে রাখি।
কেন বল তো? এই অন্ধকার ভোর থেকে এতো কী কাজ তোমার?
সহজ সাধারণ একটা প্রশ্ন করেন অনামিকা দেবী। নমিতা কিন্তু উত্তরটা দেয় অসহজ। গলা নামিয়ে বলে, থাক, ও-কথা। কে কোথা থেকে শুনতে পাবেন।
অনামিকা গম্ভীর হয়ে যান।
বলেন, যাক, আজ আমারও তোমার ওই অ্যালার্মের জন্যে সুবিধে হলো। ছটার সময় তো বেরোবার কথা।
কয়েক মাইল মোটর গাড়িতে গেলে তবে রেলস্টেশন, আর সকাল সাতটার গাড়ি ধরতে হবে।
নমিতা কিন্তু তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, সে কী, আজই চলে যাবেন কি? আরো তো দুদিন ফাংশান আছে না?
অনামিকা ওর অবোধ প্রশ্নে হাসেন।
বলেন, কথা তাই ছিল বটে। কিন্তু এর পরও ফাংশান হবে বলে ধারণা তোমার?
নমিতা মৃদু অথচ দৃঢ়স্বরে বলে, হবে। কাল আপনি শুয়ে পড়ার পর অনেক রাত্রে সম্মেলনের কারা এসেছিলেন এ বাড়িতে, জানিয়ে গেলেন। আপনি উঠলে যেন বলা হয় অধিবেশন হবে। রীতিমত পুলিস পাহারা বসাবার ব্যবস্থা হয়েছে।
পুলিস পাহারা!
রীতিমত পুলিস পাহারা দিয়ে সাহিত্য সম্মেলন!
অনামিকা দেবী কি হেসে উঠবেন? না কেঁদে ফেলবেন?
অবশ্য দুটোর একটাও করলেন না তিনি, শুধু বললেন, না, আমি আজকেই চলে যাবে। সকালের গাড়িতে হয়ে না উঠলে দুপুরের গাড়িতে। হয়ে ওঠা মানে, ওদের তো বলতে হবে।