শুধুই পৃষ্ঠবল? আর কিছু নয়?
আরও কিছু? তাও আছে হয়তো কিছু। চক্ষুলজার মায়াটা কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে পারলে অন্ততঃ রান্নাঘর ভাড়ার-ঘরটার ওপর তো নিরঙ্কুশ কর্ত্রীত্ব থাকে। সে স্বাধীনতাটুকুই কি কম?
যাঃ, তুই বড় নিন্দেকুটে। অমলবাবু তোকে সর্বস্ব দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে বসে আছেন।
সেই তো জ্বালা। পারুল কেমন একটা বিষণ্ন হাসি হেসেছিল, সর্বস্ব লাভের ভারটা তো কম নয়। সেটা না পারা যায় ফেলতে, না পারা যায় গিলতে।
ফেলতে পারা যায় না সেটা তো বুঝলাম, কিন্তু গিলতে বাধা কি শুনি?
আরে বাবা ও প্রশ্ন তো আমিই আমাকে করছি অহরহ, কিন্তু উত্তরটা খুঁজে পাচ্ছি কই? ভারটাই ক্রমশঃ গুরুভার হয়ে উঠছে।…কিন্তু সে যাক, আমার অমলবাবুর চিন্তা রাখ, তোর নির্মলবাবুৰ খবর কি বল?
আঃ অসভ্যতা করিস না।
অসভ্যতা কী রে? এতোদিনে কতদূর কী এগোলো সেটা শুনি!
তুই থামবি?
পারুল হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, হতভাগাটা বুঝি এখনো সেই মা-জেঠির আঁচলাচাপা খোকা হয়ে বসে আছে? কোনো চেষ্টা করেনি?
গম্ভীর বকুলও হয়েছিল তখন, চেষ্টা করবার তো কোনো প্রশ্নই নেই সেজদি!
ওঃ, প্রশ্নই নেই? সেই গণ-গোত্র, কুল-শীল, বামুন-কায়েত, রাঢ়ী-বারেন্দ্র? তাহলে মরতে তুই এখনো কিসের প্রত্যাশায় বসে আছিস?
প্ৰত্যাশা? প্ৰত্যাশা আবার কিরে সেজদি? বসে থাকা কথাটাও অর্থহীন। আছি বলেই আছি।
কিন্তু ভাবছি অভিভাবককুল তবে এখনো তোকে বাড়িছাড়া করবার জন্যে উঠেপড়ে লাগছে না কেন?
তা আমি কি জানি?
.
বলেছিল বকুল, তা আমি কি জানি?
কিন্তু সত্যিই কি জানতো না বকুল সে কথা? বকুলের বাবা তাঁর চিরদুর্বল অসহায় চিত্তের সমস্ত আকুলতা নিয়ে ওই মেয়েটাতেই নির্ভর করছেন না কি? বড় হয়ে ওঠা ছেলেরা তো বাপের কাছে জ্ঞাতির সামিল, অন্ততঃ বকুলের বাবার চিন্তা ওর উর্ধ্বে আর পৌঁছুতে পারে না। বিবাহিত ছেলেদের তিনি রীতিমত প্ৰতিপক্ষই ভাবেন। বিবাহিতা মেয়েদের কথা তো বাদ। আপন বলতে অতএব ওই মেয়ে। কুমারী মেয়েটা।
যদিও মেয়ের চালচলন তাঁর দুচক্ষের বিষ, তবু সময়মত এসে ওষুধের গ্লাসটা তো ও-ই সামনে এনে ধরে। ওই তো দেখে বাবার বিছানাটা ফর্সা আছে কিনা, বাবার ফতুয়াটার বোতাম আছে কিনা, বাবা ভালমন্দ একটু খাচ্ছে কিনা।
ওই ভরসাস্থলটুকুও যদি পরের ঘরে চলে যায়, বিপত্নীক অসহায় মানুষটার গতি কি হবে? হতে পারে জাত মান লোকলজ্জা, সবই খুব বড় জিনিস, কিন্তু স্বার্থের চাইতে বড় আর কী আছে? আর সবচেয়ে বড় স্বাৰ্থ প্রাণরক্ষা।
বকুল বোঝে বাবার এই দুর্বলতা।
কিন্তু এ কথা কি বলবার কথা?
নাঃ, এ কথা সেজদির কাছেও বলা যায় না। তাই বলে, আমি কি জানি। কিন্তু বাবার এই দুর্বলতাটুকুর কাছে কি কৃতজ্ঞ নয় বকুল?
পারুল বলে, তাহলে আপাততঃ তোমার খাতার পাতা জুড়ে ব্যর্থ প্রেমের কবিতা লেখাই চলছে জোর কদমে?
বকুল হেসে উঠে বলে, আমি আবার প্রেমের কবিতা লিখতে গেলাম কখন? সে তো তোর ব্যাপার! যার জন্যে অমলবাবু-
দোহাই বকুল, ফি কথায় আর তোর অমলবাবুকে মনে পড়িয়ে দিতে আসিসনে, দু-চারটি দিন ভুলে থাকতে দে বাবা।
ছিছি সেজদি, এই কি হিন্দুনারীর মনোভাব?
ওই তো মুশকিল। পারুল হেসে ওঠে, কিছুতেই নিজেকে হিন্দু নারীর খোলসে ঢুকিয়ে ফেলতে পারছি না, অথচ খোলসটা বয়েও মরছি। হয়তো মরণকাল অবধিই বয়ে মরবো।
পারুলের মুখটা অদ্ভুত একটা রহস্যের আলোছায়ায় যেন দুর্বোধ্য লাগছে, মনে হচ্ছে ইচ্ছে করলেই পারুল ওই খোলসটা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারে। বেরোচ্ছে না, শুধু যেন নিজের উপর একটা নির্মম কৌতুকের খেলা খেলে মজা দেখছে।
অনামিকা ওই মুখটা দেখতে পাচ্ছেন, সেদিকে নিষ্পলকে তাকিয়ে থাকা বকুলের মুখটাও। বকুল ফর্সা নয়, পারুলের রং চাপা ফুলের মত। পারুলের বর সেই রঙের উপযুক্ত শাড়িও কিনে দেয়। সেদিন পারুল একখানা মিহি চাঁদের আলো শাড়ি পরেছে, তার পাড়াটা কালো চুড়ি। সেই পাড়টা মাত্র খোঁপার ধারটুকু বেষ্টন করে কাঁধের পাশ থেকে বুকের উপর লতিয়ে পড়েছে। পারুলকে বড় সুন্দর দেখতে লাগছে।
চাঁদের আলো শাড়িতে লালপাড় আরো সুন্দর লাগে। কিন্তু লালপাড় শাড়ি পারুলের নাপছন্দ। কোনো উপলক্ষে এয়োস্ত্রী মেয়ে বলে কেউ লালপাড় শাড়ি দিলে পারুল অপর কাউকে বিলিয়ে দেয়। কারণটা অবশ্য বকুল ছাড়া সকলেরই অজ্ঞাত। কিন্তু বকুল ছাড়া আর কাকে বলতে যাবে পারুল, লালপাড় শাড়িতে বড় যেন পতিব্ৰতা-পতিব্ৰতা গন্ধ। পরলে মনে হয় মিথ্যে বিজ্ঞাপন গায়ে সেঁটে বেড়াচ্ছি।
ছেলেবেলায় পারুলের এমনি অনেক সব উদ্ভট ধারণা ছিল। আর ছিল একটা বেপরোয়া সাহস।
তাই পারুল তার বাপের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেছিল, বকুলের তো বিয়ের বয়স হয়েছে, আমাদের হিসাবে সে বয়েস পেরিয়েই গেছে, বিয়ে দিচ্ছেন না কেন?
পারুল-বকুলের বাবা থতমত খেয়ে বলে ফেলেছিলেন, তা দেব না বলেছি নাকি? পাত্র না পেলে? আমার তো এই অশক্ত অবস্থা, বড় বড় ভাইরা নিজ নিজ সংসার নিয়েই ব্যন্ত–
খুব একটা অশক্ত ছিলেন না ভদ্রলোক, তবু স্ত্রীবিয়োগের পর থেকেই তিনি স্বেচ্ছায় নিজেকে অশক্ত করে তুলেছিলেন। কে জানে কোন মনস্তত্ত্বে।
হয়তো অপরের করুণা কুড়োতে।