রাস্তার ধার থেকে দেখলে শুধু একসারি। আর তিনতলায় ওপরের ছাদে উঠলে——তার পিছনে, আরো পিছনে শুধু বাড়ি আর বাড়ির সারি।
কিন্তু তিনতলারও ওপরের ছাদে উঠে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখার মত বিলাসিতার সময় কোথায় বকুলের? ঘরের সামনের ছাদটুকুতে একটু দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখার সময় হয় না!
আশ্চর্য!
যখন সময় ছিল, তখন এই তিনতলার ওপরের ছাদটা পেলে একটা রাজ্য পাওয়ার সুখানুভূতি হতে পারতো, তখন ওটার জন্ম হয়নি। এখন কদাচ কোনোদিন ওই ছাদটায় ওঠবার সরু লোহার সিঁড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে কল্পনা করে বকুল, বকুলের কৈশোরকালে যদি এটা থাকতো!
থাকলে যে কী হতো তা জানে না বকুল, যদি থাকতো ভাবতে গেলেই অন্য একটা বাড়ির ছাদে একখানা হাসি-হাসি মুখ ভেসে ওঠে।
যে মুখের অধিকারীকে সেজদি পারুল বলতো, বোকা, হাঁদা, নীরেট।
অবিশ্যি সে-সব তো সেই তামাদি কালের কথা। যখন এক-আধবার আসতো পারুল বাপের বাড়িতে। অনেক দিন আগে বিয়ে হওয়া তিন মেয়ের মধ্যে পারুলই মা মারা যাওয়ার পরও মাঝে মাঝে এসেছে।
আর চাপা, চন্দন?
তারা তো আর মরণকালে কেঁদে কেঁদে বলেছিলই, মা তুমিও চললে, আমাদেরও বাপের বাড়ি আসা ঘুচলো—
যদিও তখন সেখানে উপস্থিত মহিলাকুল, যাঁরা নাকি ওদের খুড়ি জেঠি পিসি, তারা বলেছিলেন, ষাঠ-ষাঠ, বাপ বেঁচে থাকুন একশ বছর পরমায়ূ নিয়ে–
ওরা সেই ক্ৰন্দন-বিজড়িত গলাতেই সতেজ সংসারের নিয়ম বুঝতে দিয়েছিল গুরুজনবৰ্গকে। বলেছিল, থাকুন, একশো কেন হাজার বছর, মা মরলে বাপ তালুই, এ আর কে না জানে?
হয়তো মা থাকতেই বাপের ব্যবহারে তার আঁচ পেয়েছিল তারা। টের পেতো বাবার একান্ত অনিচ্ছার ওপরও মা প্ৰায় জোর করেই তাদের নিয়ে আসেন। যদিও এও ধরা পড়তে নাকি থাকতো না-এই যুদ্ধের মধ্যে স্নেহবিগলিত চিত্তটা ততো নয়, কর্তব্যবোধটাই কাজ করেছে বেশী।
সুবৰ্ণলতার এই প্ৰবল কর্তব্যবোধটাই তো প্ৰবোধচন্দ্ৰকে চিরকাল জব্দ করে রেখেছিল। প্ৰবোধচন্দ্ৰ বুঝে উঠতে পারতেন না নিজের জীবনটা নিয়ে নিজে যা খুশি করতে পারে না কেন মানুষ।
নেহাৎ অসচ্ছল অবস্থা না হলে-মানুষ তো অনায়াসেই খাওয়া থাকা আয়েস আরাম সুখভোগ করে কাটিয়ে দিতে পারে, তবে কী জন্যে মানুষ কর্তব্য নামক বিরক্তিকর একটা বস্তুকে নিয়ে ভারগ্রস্ত হতে যাবে? সেই বস্তুটার পিছনে পিছনেই তো আসবে যাতে রাজ্যের চিন্তা, আর যতো রাজ্যের অসুবিধে।
প্ৰবোধচন্দ্রের এই মতবাদের সঙ্গে চিরকাল লড়ালড়ি ছিল সুবৰ্ণলতার, কিন্তু শেষের দিকে কতকগুলো দিন যেন সুবৰ্ণলতা হাত থেকে অস্ত্ৰ নামিয়ে যুদ্ধবিরতির অন্ধকার শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
মায়ের কথা মনে করতে গেলেই বকুলের মায়ের সেই নির্লিপ্ত নিরাসক্ত হাত থেকে হালনামানো মূর্তিটাই মনে পড়ে।
মৃত্যুর অনেক আগে থেকেই সুবৰ্ণলতা যেন এ সংসার থেকে বিদায় নিয়ে নিজেকে মৃতের পর্যায়ে রেখে দিয়েছিলেন। সেই মৃত্যুর শীতলতার মধ্যে কেটেছে বকুলের কৈশোরকাল।
তবু আশ্চৰ্য, সেই শীতলতার মধ্যেই ফুটেছে ফুল, জ্বলেছে আলো।
তারপর তো সুবৰ্ণলতা সত্যিই বিদায় নিলেন।
তার কতোদিন যেন পরে সে-বার পারুল এলো বাপেরৰাড়ি।
ঠিক মনে পড়ে না কবে!
০৯. পারুল সেবার এসেছিল বাপের বাড়ি
অনেক দিন পরেই পারুল সেবার এসেছিল বাপের বাড়ি। এ পক্ষের আগ্রহের অভাবেই শুধু নয়, নিজেরও আসাটা তার কদাচিৎ হয়, কারণ শ্বশুরবাড়িতে থাকে না সে, থাকে বরের বাড়ি। বরের বদলীর চাকরি এবং বৌয়ের বদলে রাঁধুনী-চাকরের হাতে খেতে সে নারাজ, তাই বৌকে বাসায় নিয়ে গেছে মা বাপের সঙ্গে মতান্তর করে। ছেলে তার বৌকে নিয়ে গিয়ে নিজের কাছে রাখতে চাইলে কোন মা-বাপাই বা প্ৰসন্নচিত্তে সে যাওয়াকে সমর্থন করতেন তখন? বৌ যদি নাচতে নাচতে বরের সঙ্গে বাসায় যায়, এবং সেখানে পূর্ণ কর্ত্রীত্বের স্বাদ পায়, আর কি কখনো সে বৌ শাশুড়ী পিসশাশুড়ীর ছত্ৰতলে বৌগিরি করতে রাজী হবে? কদাচ না।
তাহলে আর কি? বাসায় যাওয়া মানেই বৌয়ের পরকাল ঝরঝরে হয়ে যাওয়া। কি জন্যে তবে ছেলেকে মানুষ-মুনুষ করে বড় করে তুলে তার বিয়ে দেওয়া, যদি ছেলের বৌয়ের হাতের সেবা-যত্নটুকু না পেলেন? কিন্তু পারুলের বর বৌয়ের সেই কর্তব্যের দিকটা দেখেনি, নিজের দিকটাই দেখেছে।
আর পারুল? পারুলের একটা কর্তব্যৰোধ নেই? অন্ততঃ চক্ষুলজ্জা?
বকুলের সেই প্রশ্নের উত্তরে পারুল হেসে উঠে বলেছিল, হ্যাঁ, সেটা অবিশ্যি দেখাতো ভালো। আমি যদি শাশুড়ীর পা চেপে ধরে বলতে পারতাম, ওই বেহায়া নির্লজ স্বাৰ্থপরটা যা বলে বলুক, আমি আপনার চরণ ছাড়ব না, তাহলে নিশ্চয়ই ধন্যি-ধন্যি পড়ে যেতো। কিন্তু সেই ধন্যি-ধন্যিটার মধ্যে আছে কী বল? ছদ্মবেশ ধারণ করে ধন্যি-ধনি কুড়োনোয় আমার দারুণ ঘেন্না। তাছাড়া-পারুল আরো একটু হেসেছিল, লোকটাকে দগ্ধে মারতে একটু মায়াও হলো। আমায় চোখছাড়া করতে হলে ও তো অহরহ অগ্নিদাহে জ্বলতো।
বকুলও হাসে।
কুমারী মেয়ে বলে কিছু রেখেঢেকে বলে না। আহা শুধু তারই নিন্দে করা হচ্ছে। নিজের দিকে যেন কিছুই নেই। অমলবাবু বাক্স-বিছানা বেঁধে নিয়ে ভাগলবা হলে, তুই নিজে বুঝি বিশ্বভুবন অন্ধকার দেখতিস না?
তা তাও হয়তো দেখতাম। যতই হোক বেঘোরে বেপোটে একটা পৃষ্ঠবল তো!