সম্মুখবর্তিনীর একখানা হাত চেপে ধরে হেসে বলে ৰসে, অদৃশ্য হলে বুঝি শুধুই গল্পে ছাড়বো?
আহা! ধ্যেৎ!
ওই আহার সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য হাত ছাড়ানো হয়ে গেছে।
ছাত থেকে ছাতে একটা ফেলা সিঁড়ি থাকলে বেশ হত! ডিটেকটিভ গল্পে যেমন দড়ির মইটই থাকে-
হ্যাঁ, এমনই সব কথা।
কিন্তু কেন যে, ওই সব দূরূহ পথের চিন্তা, তা দুজনের একজনও জানে না।
শুধু যেন দেখা হওয়াটাই শেষ কথা।
বকুল এ-যুগের এই অনামিকা দেবীর ভাইঝির মতো বলে উঠতে পারবার কথা কল্পনাও করতে পারতো না, আগে মনস্থির কর বাড়ির অমতে বিয়ে করতে পারবে এবং বিয়ে করে বৌকে রাজার হালে রাখতে পারবে, তবে প্রেমের বুলি কপচাতে এসো!
বকুলের যুগ অন্য ছিল।
বকুল মেয়েটাও বোধ হয় আরো বেশী অন্য টাইপের ছিল।
তাই বকুলের অভিমান ছিল না, অভিযোগ ছিল না, শুধু ভালবাসা ছিল। মানে সেই গোয়ালার দুধের জোলো ভালোবাসাই।
বকুল বললো, কই বইটা দাও, পালাই।
এসেই কেবল পালাই-পালাই!
তা কী করবো, বাঃ!
যদি যেতে না দিই, আটকে রাখি?
ইস! ভারী সাহস। আটকে রেখে করবে কি?
কিছু না এমনি।
সঙ্গীন মুহূর্তগুলো এইভাবেই ব্যর্থ করতো নির্মল।
কারণ ওর বেশী ক্ষমতা তার ছিল না।
ওই ছেলেটার দিকে তাকিয়েও মায়া হয় অনামিকা দেবীর।
বলতে ইচ্ছে করে, বেচারা!
কিন্তু সেদিন ওই বেচারাও রেহাই পায়নি। শেষরক্ষা হয়নি। যখন বইটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছে, সামনেই জেঠি জপের মালা হাতে।
ওমা, ই কি কাণ্ড! বকুল তুই এখানে? ওদিকে তোদের বাড়ি থেকে-তা বই নিতে এসেছিলি বুঝি?
হুঁ।
আমি তো তা জানি না। তাহলে বলে দিতাম তোর ভাইপোকে। আমি এসেছি ছাদটা পরিষ্কার আছে কিনা দেখতে। দুটো বড়ি দেব কাল।
কাল বড়ি দেবেন জেঠি, আজ তাই জপের মালা হাতে ছুটে এসেছেন, ছাদ পরিষ্কার আছে কিনা দেখতে!
আর ভাইপো?
সে খবরটা সম্পূর্ণ কল্পিতও হতে পারে। জানা তো আছে বকুল বাড়ি গিয়ে ভেরিফাই করতে যাবে না। অথবা সত্যিই হতে পারে। বড়দা যেই টের পেয়েছে বকুল বাড়ি নেই, পাঠিয়েছে।
.
কলকাতার দক্ষিণ অঞ্চলে রাজেন্দ্রলাল স্ট্রীটের একেবারে রাস্তার উপর বয়সের ছাপধরা এই বাড়িখানার দোতলায় সাবেকি গড়নের টানা লম্বা দালানের উঁচু দেয়ালে সিঁড়ির একেবারে মুখোমুখি চওড়া ফ্রেমের বেষ্টনীর মধ্যে আবদ্ধ যে মুখখানি দেদীপ্যমান, সে মুখ এ বাড়ির মূল মালিক প্ৰবোধচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের।
চারিদিকে খোলা জমির মাঝখানে সস্তায় জমি কিনে তিনিই এই বাড়ি খানি বানিয়ে একান্নাবর্তী পরিবারের অন্ন-বন্ধন ছিন্ন করে এসে আপন সংসারটিকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বর্তমান মালিকরা, অর্থাৎ প্ৰবোধচন্দ্রের পুত্ররা এবং তাদের বড়ো-হয়ে-ওঠা পুত্ররা অবশ্য প্ৰবোধচন্দ্রের দূরদর্শিতার অভাবকে ধিক্কার দেয়, কারণ আশেপাশের সেই ফেলাছড়া সস্তা জমির দুচার কাঠা জমি কিনে রাখলেও এখনকার বাজারে সেইটুকু জমি বেচেই লাল হয়ে যাওয়া যেতো। কিন্তু অদূরদর্শী প্ৰবোধচন্দ্ৰ কেবল নিজের মাপের মতো জমি কিনে আজেবাজে প্ল্যানে শুধু একখানা বাড়ি বানিয়ে রেখেই কর্তব্য শেষ করেছিলেন; যে বাড়িটায় তার পুত্র-পৌত্রবর্গের মাথা গুঁজে থাকাটুকু পর্যন্তই হয়। তার বেশি হয় না। অথচ সুপরিকল্পিত নক্সায় ফ্ল্যাটবাড়ির ধাঁচে বাড়িটা বানালে যে, একতলার খানিকটা অংশ ভাড়া দিয়ে কিছুটা আয় করা যেত এখন, সেটা সেই ভদ্রলোকের খেয়ালেই আসেনি।
এদেরও অথচ খেয়ালে আসে না, ফ্ল্যাট শব্দটাই তখন অজানা ছিল তাঁদের কাছে! তখন সমাজে ফ্ল্যাটের অনুপ্রবেশ ঘটাবার আভাসও ছিল মা! বাসা ভাড়া, ঘর ভাড়া, বাড়ি ভাড়া এই তো কথা।
খেয়াল হয় না বলেই যখন-তখন সমালোচনা করে।
তবে হ্যাঁ, স্বীকার করে ঘরটরগুলো ঢাউশ ঢাউশ, আর ফালতু ফালতু এদিক ওদিক ক্ষুদে ক্ষুদে ঘরের মতন থাকায় ফেলে ছড়িয়ে বাস করার সুবিধে আছে।
কিন্তু ওই যে লম্বা দালানটা একতলায়, দোতলায়? কী কাজে লাগে ও দুটো? যখন সপরিবারে পিঁড়ি পেতে পংক্তিভোজনে বসার ব্যবস্থা ছিলো, তখন নীচের তলার দালানটা যদিও বা কাজে লাগতো, এখন তো তাও নেই। এখন তো আর পরিবারের সকলেই একান্নভুক্ত নয়? যাঁরা আছেন তাঁরা নিজ নিজ অন্ন পৃথক করে নিয়েছেন এবং খাবার জন্যে এলাকাও ভাগ করে নিয়েছেন।
প্ৰবোধচন্দ্রের বড় ছেলে অবশ্য এখন আর ইহ-পৃথিবীর অন্নজলের ভাগীদার হয়ে নেই, তার বিধবা স্ত্রী একতলায় নিজস্ব একটি পবিত্র এলাকা ভাগ করে নিয়ে আপন হবিষ্যান্নের শুচিতা রক্ষার মধ্যে বিরাজিতা, তারই জ্যৈষ্ঠপুত্র অপূর্ব দোতলার ঘর-বারান্দা ঘিরে নিয়ে নিজের মেলোচ্ছপনার গণ্ডির মধ্যে বিরাজমান।
অপুর্বর আর দুই ভাই চাকরি-সূত্রে ঘরছাড়া, তারা দৈবাৎ কোনো ছুটিতে কেউ আসে, কোনোদিন মায়ের রান্নাঘরে, কোনোদিন বৌদির রান্নাঘরে, আর কোনো-কোনোদিন নেমন্তন্ন খেয়েই কাটিয়ে চলে যায়। একজন থাকে রেঙ্গুনে, একজন ত্রিপুরায়, যেতে আসতেই সময় যায়। নেমন্তম জোটে কাকাদের ঘরে, শ্বশুরবাড়ির দিকের আত্মীয়দের বাড়িতে, কদাচ বড় পিসির বাড়ি। কলকাতায় বড় পিসি চাঁপাই আছে।
প্ৰবোধচন্দ্রের মেজ ছেলে, যাঁর ডাকনাম কানু, তার সংসার নিয়ে দোতলার আর এক অংশে বাস করেন। তিনি। তাঁর গিন্নী বাতের রোগী, নড়াচড়া কম, ছেলেমেয়েরা চাপা আর মুখচোরা স্বভাবের, তাদের সাড়াশব্দ খুব কম পাওয়া যায়।