টেলিফোনটা ডেকে উঠলো ঘরের কোণ থেকে। আবার চেয়ার ছেড়ে উঠলেন অনামিকা দেবী, রিসিভারটা তুলে নিলেন হাতে।
টেলিফোনটা লেখার টেবিলে রাখাই সুবিধে, সময় বঁচে, পরিশ্রম বাঁচে, তবু কোণের ওই ছোট্ট টেবিলটার উপরেই বসিয়ে রাখেন সেটা অনামিকা দেবী। এটা তার এক ধরনের শপ। বার ব্যার উঠতে হলেও।
থেমে থেমে কেটে কেটে বললেন, হ্যাঁ, আমি কথা বলছি, বলুন কি বলছেন?..নতুন পত্রিকা বার করছেন? শুনে খুশি হলাম। শুভেচ্ছা জানাচ্ছি, সাফল্য কামনা করছি।…লেখা? মানে গল্প? পাগল হয়েছেন?…কী করবো বলুন? অসম্ভব, সম্পূর্ণ অসম্ভব।. উপায় থাকলে না করতাম না।…বেশ তো চলুক না কাজ, পয়ে হবে। কী বলছেন? আপনি বলব না? বয়সে আপনি আমার থেকে অনেক ছোট? ঠিক আছে, না হয় তুমিই বলা যাবে। কিন্তু গল্প তো দেওয়া যাচ্ছে না।…কী? কী বলছেন? কথা দিয়ে রাখবো?…না না। ওইটি পারবো না, কথা দিয়ে বসে থাকতে থারবো না। সে আমাকে বৃশ্চিক–যন্ত্রণা দেবে।...তা বটে। বুঝছি তোমার খুব দরকার, কিন্তু উপায় কি?
উপায় কি? অপর অর্থ নিরুপায়। তা সত্ত্বেও ও-পক্ষ তার নিজের নিরুপায়তার কথা ব্যক্ত করে চলে এবং কথার মাঝখানে এমন একটু কমা সেমিকোলন রাখে না, ফাঁকিটুকুতে ফুলস্টপ বসিয়ে দিতে পারেন অনামিকা দেবী।
অতএব শেষ পর্যন্ত বলতেই হয়, আচ্ছা দেখি।
ও–পক্ষের উদ্দণ্ড কণ্ঠের ধ্বনি এ ঘরের দেওয়ালে ধাক্কা মারে, না না, দেখিটেখি নয়। আমি নাম অ্যানাউন্স করে দিচ্ছি।
ছেড়ে দিলো এবার।
অনামিকা দেবীকে আর কিছু বলবার অবকাশ না দিয়ে।
অনামিকা দেবী জানেন, এরপর যদি তিনি সময়ে লেখা দিয়ে উঠতে না পারেন, তাহলে ওই ভাবী সম্পাদক ভদ্রলোক এখানে সেখানে সকরুণ গলায় বলে বেড়াবেন, কী করবো বলুন, কথা দিয়ে যদি কথা না রাখেন! এই তো আমাদের দেশের অবস্থা। কেউ একটু নাম করলেন কি অহঙ্কার! আমাদেরও হয়েছে শাঁখের করাত। ওনাদের লেখা না নিলেও নয়–।
বলেন বটে না নিলেও নয়, কিন্তু আসল ভরসা রাখেন তঁরা সিনেমাস্টারদের ছবির উপর। তারা কী ভাবে হাঁটেন, কী ভাবে চলেন, কোন ভঙ্গীতে কলা ছাড়িয়ে মুখে ফেলেন, কোন ভঙ্গীতে দোলে আবীর ছড়ান, ইত্যাদি প্রভৃতি সব! ওই ভঙ্গীগুলিই ওদের পত্রিকার মূল জীবনীরস, তা ছাড়া তো আছে ফিচার। তথাপি গল্প–উপন্যাসও আবশ্যক, সব শ্রেণীর পাঠককেই তো মুঠোয় পুরতে হবে। আর সেক্ষেত্রে ওই নাম করে ফেলা লেখকদের লেখা নেওয়াই নিরাপদ, পাণ্ডুলিপিতে চোখ বোলাতে হয় না, সোজা প্রেসে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। নতুন কাগজের সম্পাদকও এ ছাড়া নতুন কিছু করবেন কি?
আগে নাকি সাংবাদিকতার একটি পবিত্র দায়িত্ব ছিল। সম্পাদকেরা নাকি লেখক তৈরী করতেন, তৈরী করতেন পাঠকও। অনামিকা দেবী যে সে বস্তু দেখেননি তা নয়। তাঁর জীবনেই তিনি একদা সেই উদার আশ্রয় পেয়েছেন।
কিন্তু কদিনের জন্যেই বা?
সেই মানুষ চলে গেলেন।
তারপর কেমন করে যেন অনামিকা দেবী এই হাটে দাঁড়িয়ে গেছেন, চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলা দেশের পাঠক–পাঠিকারা অনামিকা দেবীকে ভালবাসে।
রিসিভার নামিয়ে রেখে আবার এসে কলম নিয়ে বসলেন অনামিকা দেবী, আর ওর ভাইঝি। শম্পার কথাটা আবার নতুন করে মনে এল।
আচ্ছা পিসি, তত্বার ওঠা উঠি করতে হয়, ওটাকে তো তোমার লেখার টেবিলে রেখে দিলেই পারে।
অনামিকা দেবী নিজের উত্তরটাও ভাবলেন, নাঃ! টেবিলে টেলিফোন বসানো থাকলে, ঘরটাকে যেন অফিস ঘর অফিস ঘর লাগে।
হ্যাঁ, এই কথাই বলেন বটে, কিন্তু আরও কারণ আছে। আর হয়তো সেটাই প্রকৃত কারণ। মাঝে মাঝেই একটি তাজা আর সপ্ৰতিভ গলা কথা কয়ে ওঠে, শম্পাকে একটু ডেকে দিন তো!
ডেকে দেন অনামিকা দেবী।
শম্পা আহ্লাদে ছলকাতে ছলকাতে এসে ফোন ধরে। পিসির দিকে পিঠ আর দেওয়ালের দিকে মুখ করে গলা নামিয়ে কথা বলে মিনিটের পর মিনিট, ঘণ্টায় গিয়ে পৌঁছয়।
টেবিলে রাখলে অসুবিধে উভয় পক্ষেরই। শম্পার জীবনে এখন একটি নতুন প্রেমের ঘটনা চলছে। এখন শম্পা সব সময় আহ্লাদে ভাসছে।
অনামিকা দেবী সঠিক খবর জানেন না, সত্যি কিছু আর সব খবর রাখেনও না, তবু যতটুকু ধারণা তাতে হিসেব করেন, শম্পার এ ব্যাপারে এই নিয়ে সাড়ে পাঁচবার হলো। সাড়ে অর্থে এটা এখনও চলছে, তার মানে অর্ধপথে।
প্রথম প্রেমে পড়েছিল শম্পা ওর দূর–সম্পর্কের মামাতো দাদা বুবুলের সঙ্গে। শম্পার তখন এগার বছর বয়েস, বুবুলের বছর সতেরো।
মফঃস্বলের কোনো স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল পাস করে, জায়গার অভাবে এই দূর সম্পর্কের পিসির বাড়িতে থেকে কলেজে পড়তে এসেছিল বুবুল।
চাঁদের মত ছেলে, মধুর মত স্বভাব, নিঃস্বও নয়। বাপ টাকা পাঠায় রীতিমত। কার আর আপত্তি হবে? পিসিরও হল না। মানে অনামিকার ছোটবৌদির।
কিন্তু জোরালো আপত্তি হল তার ভাইপোর সঙ্গে মেয়ের প্রেমে পড়ায়, তিনি প্রথমে বিনিপয়সায় বাড়িতে এসে–পড়া (যেগুলোর জন্যে অনামিকা দেবী দায়ী) রাশি রাশি সিনেমা পত্রিকার দোষ দিলেন, অনামিকা দেবী রচিত প্ৰেমকাহিনীগুলির প্রতি কটাক্ষপাত করলেন, তারপর মেয়েকে তুলে ধুনলেন এবং ভাইপোকে পথ দেখতে বললেন।
এগারো বছরের মেয়ের উপর এ চিকিৎসা চালানো গেল, অনামিকা দেবীর ছোটবৌদি ভাবলেন, যাক, শিক্ষা হয়ে গেল। আর প্রেমে পড়তে যাবে না মেয়ে।
কিন্তু কী অলীক সেই আশা!
সাড়ে বারো বছরেই আবার প্রেমে পড়ল। শম্পা, পাড়ার এক স্টেশনারী দোকানের সেলসম্যান ছোকরার সঙ্গে। খাতা পেনসিল রবার আলপিন চকোলেট ইত্যাদি। কিনতে গিয়ে আলাপের শুরু, তারপর কোন ফাঁকে আলাপ গিয়ে প্ৰেমালাপের পর্যায়ে উঠে বসলো। বিনা পয়সায় চকোলেট আসতে লাগলো।