কাকিমার এক মস্ত বাতিক চটের আসন বোনা, তাই তিনি সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে বড় জা ও দজ্জাল ননদের চোখ এড়িয়ে যখন-তখনই ওই চটের আসন নিয়ে বসতেন। ওই আসনের ঘর থেকে চোখ না তুলেই তিনি জবাব দিলেন, নির্মল? এই তো একটু আগেই ছিল। আছে বোধ হয়। দেখগে দিকি তার পড়ার ঘরে। বাবার আবার শরীর খারাপ হল?
হুঁ।
আহা তোর মা গিয়ে অবধি যা অবস্থা হয়েছে! মানুষটা আর বোধ হয় বাঁচবে না। যা দেখগে যা। কোন ডাক্তার কে জানে? আমাদের অনাদিবাবু তো-
ততক্ষণে বকুল হাওয়া হয়ে গেছে। পৌঁছে গেছে নির্মলের পড়ার ঘর, মানে এদের তিনতলার ছাদের চিলেকোঠার ঘরে।
কিন্তু এসে কি বকুল তার প্ৰেমাস্পদের বুকে আছড়ে পড়তো? নাকি নিবিড় সান্নিধ্যের স্বাদ নিতো?
কিছু না, কিছু না।
এ যুগের ছেলেমেয়েরা সেকালের সেই জোলো জোলো প্রেমকে শহুরে গোয়ালার দুধের সঙ্গে তুলনা করবে।
ধরা সেদিনের কথাই
বকুল হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললো, বলতে হল বাবার হাঁপানিটা আবার বেড়েছে, সেই পাপে নিজেরই হাঁপানি ধরে গেল।
নির্মল এগিয়ে এসে হাতটাও ধরলো না, শুধু কৃতাৰ্থমন্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, কাকে বললে?
বললাম কাকিমাকে। এই মিছে কথা বলার পাপটি হল তোমার জন্যে।
নির্মলের মুখে অপ্রতিভের ছাপ।
খুব মিছে কথা আর কি? মেসোমশাই তো ভুগছেনই।
নির্মলের মাকে বকুল কাকিমা বলে, নির্মলের জেঠাইমাকে জেঠাইমা, কিন্তু নির্মল বকুলের মাকে যে কোন নিয়মে মাসীমা বলতো, আর বাবাকে মেসোমশাই,-কে জানে! তবে বলতো তাই।
ডাকা হচ্ছিল কেন?
এমনি। দেখা-টেখা তো হয়ই না। আর। অথচ লাইব্রেরী থেকে সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের একখানা নতুন বই আনা পড়ে রয়েছে।
বকুল উৎসুক গলায় বলে, কই?
দেব পারে। আগে একটু বসবে, তবে।
বসে কি হবে?
এমনি।
খালি এমনি আর এমনি! নিজে যেতে পারেন না বাবু!
নিজে?
নির্মল একটা ভয়ের ভান করে বলে, ও বাবা! তোমার বড়দার রক্তচক্ষু দেখলেই গায়ের রক্ত বরফ হয়ে যায়! যা করে তোকান আমার দিকে!
বড়দা তোমার থেকে কী এমন বড় শুনি যে এতো ভয়! বাবা তো কিছু বলেন না। মা তো—তোমাকে কতো–
হা, মাসীমা তো কত ভালোবাসতেন। গেলে কতো খুশি হতেন। কিন্তু বড়দা? মানে বেশী বড় না হলেও, সাংঘাতিক ম্যান! পুলিস অফিসার হওয়াই ওঁর উপযুক্ত পেশা ছিল।
তা আমারই বুঝি খুব ইয়ে? পিসি আর জেঠির সামনে পড়ে গেলে-
এই, আজকে পড়নি তো?
নাঃ! জেঠিমা বোধ হয় পুজোর ঘরে। আর পিসি রান্নাঘরে।
সত্যি ওঁদের জন্যে তোমার-
নির্মল একটা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে।
বকুলের চোখে আবেগের ছায়া।
বকুল ক্ষুব্ধ অভিমানের গলায় বলে, সত্যি, ওঁদের জন্যে তোমার-বলে নিঃশ্বাস ফেললেই তোমার সব কাজ মিটে গেল, কেমন?
কী করবো বল?
ঠিক আছে। আমি আর আসছি না।
না না, লক্ষ্মীটি, রাণীটি! অত শাস্তি দিও না।
ওই!
প্ৰেম সম্বোধনের দৌড় ওই পর্যন্তই।
আর প্রেমালাপের নমুনাও তো সেই লাইব্রেরীর বই, আর কেউ আসছে কিনা এইটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ।
কেউ এসে তো কোনো দৃশ্যই দেখবে না, তবু ভয়।
ভয়-ভয়! ভালবাসা মানেই ভয়।
বারেবারেই মনে হয় পিছনে বুঝি কেউ এসে দাঁড়ালো। বারেবারেই মনে হয় বাড়িতে হঠাৎ খোঁজ পড়লেই ধরা পড়বে বকুল নির্মলদের বাড়ি গেছে।
সেই ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তো ধরা পড়ে যাবে ওই ছুতোটা ছুতোই।
বাবা বলবেন, কই, নির্মলকে বলতে যেতে তো বলিনি! শুধু বলেছিলাম, নির্মলদের বাড়িতে তো বড় বড় অসুখেও হোমিওপ্যাথি চালায়!
আর দাদা বলবে, ও বাড়িতে গিয়েছিলি কী জন্যে? ও বাড়িতে? কী দরকার ওখানে? ধিঙ্গী মেয়ের এতো স্বাধীনতা কিসের?
তবু না এসেও তো পারা যায় না।
তবে এ বাড়িতে মুখোমুখি কেউ বলে ওঠে না, এ বাড়িতে এসেছ কি জন্যে? এ বাড়িতে? এতো বেহায়ামি কেন?
এ বাড়িতে যেন সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি।
দৈবাৎ যদি জেঠি এসে উপস্থিত নাও হন, সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামবার সময় তো কারুরনা-কারুর সঙ্গে দেখা হয়েই যাবে। হয়তো পিসিরই সঙ্গে।
পিসিও ভুরু কুঁচকে বলবে, বকুল যে। কতক্ষণ এসেছিস?
বকুলকে বলতে হবে, এই একটু আগে।
কোথায় ছিলি? কই দেখিনি তো?
ইয়ে-নির্মলদা লাইব্রেরীর একটা বই দেবেন বলেছিলেন–
ও; বই! তা ভাইপোটাকে একটু পাঠিয়ে দিলেও তো পারিস বাছা! বাপের এই অসুখ, আর তুই ডাগর মেয়ে বই বই করে তাকে ফেলে রেখে এসে-আবার সেই হাঁপাতে হাঁপাতে তিনতলার ছাদে যাওয়া। নির্মল ছিল বাড়িতে?
হাঁ।
গলার মধ্যে মরুভূমি, চোখের সামনে অর্থই সমুদ্র। তবু সেই গলাকে ভিজিয়ে নিয়ে বলতে হয়–হ্যাঁ। এই যে দিলেন বই।
নভেল-নাটক?
ইয়ে, না। গল্পের বই।
ওই একই কথা! তা এ বয়সে এতো বেশী নভেল-নাটক না পড়াই ভালো মা, কেবল কুচিন্তা মাথায় আসার গোড়া। বাবা গা করছেন না তাই, নচেৎ বয়সে বিয়ে হলে তো এতো দিনে দুছেলের মা হয়ে বসতিস।
এই উপদেশ! এই ভাষা!
তাই বকুল বলে, এই ছাত থেকে ছাতে যদি অদৃশ্য হয়ে উড়ে যাওয়া যেতো!
প্ৰভাত মুখুয্যের মনের মানুষের গল্পের মতো!
যা বলেছ। সত্যি ভীষণ ইচ্ছে হয় স্বপ্নে কোনো একটা শেকড় পেলাম, যা মাথায় ছোঁয়ালেই অদৃশ্য হয়ে যাওয়া যায়! তোমার মাথায় আর আমার মাথায় ঠেকিয়ে নিয়ে বেশ সকলের নাকের সামনে বসে গল্প চালানো যায়-
হঠাৎ ভীরু নির্মল একটা সাহসীর কাজ করে বসে।