জেঠিমা বালবিধবা, জেঠিমা অতএব নিঃসন্তান। কিন্তু জেঠিমার সীমাহীন স্নেহসমূদ্র সৰ্বক্ষণ অভিষিক্ত করছে দেবর-পুত্রকন্যাদের। সেই অভিষিক্ত প্রাণীগুলো কি এমনই অকৃতজ্ঞ হবে যে তার প্রতি সশ্রদ্ধ সমীহশীল হবে না? বকুলেরই বা উপায় কি সেটা না হবার?
বকুলকেও জেঠির সঙ্গে সঙ্গে হয়তো তার নিরিমিষ রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে বসতে হত এবং জেঠি শাক বাছতে বাছতে, কিংবা খুন্তি নাড়তে নাড়তে সুমধুর প্রশ্ন করতেন, তা হ্যাঁরে বকুল, তোর বাবা কি নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে? তোর বিয়ের কিছু করছে না?
বলা বাহুল্য বকুলের দিক থেকে এ প্রশ্নের কোনো জবাব যেতো না। জেঠি পুনঃপ্রশ্ন করতেন, হচ্ছে কোনো কথাবার্তা? শুনতে পাস কিছু? তারপর ওই নিরুত্তর প্রাণীটার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নির্মলের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলতেন, বুঝলে ছোটবৌ…মেয়ের বিয়েটিয়ে আর দিচ্ছে না বকুলের বাবা, লাউ-কুমড়োর মতো পাঁড় রাখবে!
নির্মলের মা মানুষটা বড় সভ্য ছিলেন, এ ধরনের কথায় বিব্রত বোধ করতেন, কিন্তু দোর্দণ্ড প্রতাপ বড় জায়ের কথার উপর কথা বলার ক্ষমতা তার ছিল না।
তিনি অতএব শ্যাম কুল দুই রাখার পদ্ধতিতে বলতেন, মা-টি মারা যাওয়াতে আরো গড়িয়ে গেল! নইলে দিদি হয়ে যেতো এতোদিনে। ভদ্রলোক আরও তিন-তিনটে মেয়ে তো পার করেছেন।
জেঠিমা এ যুক্তিতে থেমে যেতেন না, তেতো-তেতো গলায় বলতেন, করেছেন, তখন সময়কালে। মেয়েরা নিজের ছক্কা পাঞ্জা হয়ে ওঠকার আগে। এবার ক্রমশঃ যতো শেষ, ততো বেশ। বকুল হল নভেলপাড়া একেলে মেয়ে, ও হয়তো একখানা লভ-টিভ করে বসে ব্যাপকে বলে বলবে, বাবা, হাড়ি ডোম বামুন কায়েত যাই হোক, অমুক লোকটার সঙ্গেই বিয়ে করতে চাই।…কী রে বকুল, বলবি নাকি?
জেঠিমা হেসে উঠতেন।
জেঠিমার সামনের একটা দাঁত ভাঙা ছিল, সেই ভাঙা দাঁতের গহ্বর দিয়ে হাসিটা যেন ছিটকে ছিটকে বেরিয়ে আসতো।
তাই জেঠি মিনিট কয়েক পরেই বলে উঠতেন, বকুল, কুমড়োফুলের বড়া-ভাজা খাবি?. কেন, না কেন? পিটুলীবাটা দিয়ে মুচমুচে করে ভেজেছি। নে একখানা ধর। তোরা যখন এ বাড়িতে প্রেথম এলি, তুই তো তখন কাঁথায় শোওয়া মেয়ে, তোর মা মাঝে মাঝে বেড়াতে আসতো। তা একদিন এমনি কুমড়োফুলের বড় ভাজছি, বললাম, গরম গরম ভাঁজছি, খাও দুখানা; খেয়ে অবাক, বলে পিটুলীবাটা দিয়ে যে এমন বড় হয় এ তো কখনো জানি না, ভাল-বাটা দিয়ে হয় তাই জানি।
বকুলের সেই এক আবেগ-থরথর মুহূর্তের উপর চিলের ডানার ঝাপটা বসিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে এসে এইরকম সব আলাত-পালাত অবান্তর কথা বলতে শুরু করতেন জেঠি, হয়তো বা কিছু খাইয়েও ছাড়তেন। অবশেষে বকুলকে তার বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে তবে ফিরতেন।
আর শেষবেশ আর একবার বলতেন, তোর বাপকেই এবার ধরতে হবে দেখছি। সোমত্ত মেয়ে শূন্যপ্ৰাণ নিয়ে এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াবে, ঘরসংসারে মাথা দেবে না, আর বাপ বসে বসে পরিবারের শোকে তুষ হতে থাকবেন এটা তো নেয্য নয়।
বকুল মরমে মরে যেতো, বকুল লজ্জায় লাল হয়ে যেতো, বকুল মাথা তুলতে পারতো না। ওই মাথা-নীচু চেহারাটার দিকে তাকিয়ে অনামিকা দেবীর আর একবার মনে হল, বেচারা!
জেঠির এই নেয্য কথার হূলটির জ্বালা সহজে মিটতো না, অনেকদিন ধরেই তাই ওবাড়ির চৌকাঠে বকুলের পদচিহ্ন পড়তো না। সমন্ত আবেগ আকাঙ্খাকে দমন করে বকুল আপন খাতাপত্রের জগতে নিমগ্ন থাকতে চেষ্টা করতো। কিন্তু সে তপস্যা কি স্থায়ী হত? দুর্বার একটা আকর্ষণ যেন অবিরত টানতে থাকত বকুলকে ওই বাড়িটার দিকে। তাছাড়া ও বাড়ির রাস্তার দিকের জানলায় ছাতের আলসে ধরে একখানি বিষণ্ণ-বিষণ্ণ মুখ মিনতির ইশারায় তপোভঙ্গ করে ছাড়তো।
ভাবলে হাসি পায়, একটা পুরুষ ছেলে প্ৰায় একটা ভীরুলাজুক তরুণী মেয়ের ভূমিকায় রেখে দিতো নিজেকে।
বকুল ওই আবেদন-ভরা চোখের আহ্বানকে অগ্রাহ্য করতে পারতো না। বকুল আবার একদিন কোনো একটা ছুতো করে আস্তে ও-বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়াতো।
বকুলের সেই ছুতোটা আদৌ জোরালো হত না, কাজেই ছুতোটা অতি সহজেই ছুতো বলেই ধরা পড়তো।
কিন্তু অবোধ বকুল আর তার অবোধ প্ৰেমাস্পদ দুজনেই ওরা ভেবে নিতো বড়দের বেশ ফাঁকি দেওয়া গেল।
যেমন একদিনের কথা-বাবার আবার হাঁপানির টানের মত হয়েছে আর হোমিওপ্যাথির পর বকুলের বাবার আস্থা, এবং পাশের বাড়ির নির্মল নাকি কোন একজন ভালো হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের নাম জানে। এ কি একটা কম বড় ছুতো!
অতএব বকুল এসে অনায়াসেই নির্মলের মার কাছে জিজ্ঞেস করতে পারে, কাকিমা নির্মলদা কি বাড়ি আছেন? বাবা বলছিলেন নির্মলদা নাকি কোন একজন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার—মানে সেই হাঁপানি মতনটা আবার একটু—
স্পষ্ট স্পষ্ট করে নির্মলদা নামটা উচ্চারণ করতে হয়, যেন কিছুই না। যেন ওই নামটা উচ্চারণ করতে গিযে ওর গলা কাঁপে না, ওর বুকের মধ্যেটা কেমন যেন ভয়-ভয় করে না। তবে নির্মলের মা মানুষটি নিতান্তই ভালমানুষ, অতএব সরলচিত্ত। ওই ছেলেবেলা থেকে বড়চিত ছেলেমেয়ে দুটো যে আবার কোনো নতুন পরিচয়ের মধ্যে নতুন হয়ে উঠতে পারে, এমন সম্ভাবনা তার মাথায় আসতো না। এবং তার ভালমানুষ ছেলেটা এবং পাশের বাড়ির নিরীহ মেয়েটা যে তাঁর সঙ্গে এমন চাতুরী খেলতে পারে তা ভাবতেও পারতেন না। কাজে কাজেই জানলা থেকে চোখের ডাক পেয়ে বিভ্রান্ত হয়ে চলে আসা বকুল ওঁর সামনে বেশ সপ্ৰতিভ গলায় বলতে পারতো, কাকিমা নির্মলদা কি বাড়ি আছেন?