আচ্ছা বাল্য আর কৈশোরের সীমারেখাটা বয়সের কোন রেখায় টানা হত সে যুগে!
বকুল জানে না সে কথা।
বকুল দশ—এগারো বছর বয়েস থেকেই শুনে আসছে, ধাড়ি মেয়ে, তোমার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবার এত কী দরকার?.. ধিঙ্গী অবতার! এবাড়ি ওবাড়ি বেড়িয়ে বেড়ানো হচ্ছে? যাও না সংসারের কাজ করগে না।…ছাতে ঘোরা হচ্ছিল? কেন? বড় হয়েছো, সে খেয়াল কবে হবে?
বড়দা বলতো, বাবা বলতেন।
বড়দাই বেশী।
আর বড়দার ওই শাসন-বাণীর মধ্যে যেন হিতচেষ্টার চাইতে আক্ৰোশটাই প্রকট ছিল। পাশের বাড়ির ওই নির্মলটার যে এ বাড়ির বকুল নামের মেয়েটার প্রতি বেশ একটু দুর্বলতা আছে, সে সত্য বড়দার চোখে ধরা পড়তে দেরি হয়নি। অতএব এদিক ওদিক কিছু দেখলেই বড়দার দেহের শিরায় শিরায় প্রবাহিত সনাতনী রক্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠতো এবং শাসনের মাত্রা চড়ে উঠতো। বড়দা নির্মলকেও দূচক্ষের বিষ দেখতো। সে কি নির্মল বড়লোকের একমাত্র ছেলে বলে?
বকুলের মা বেঁচে থাকতে তবু বকুলের পৃষ্ঠবল ছিল। মা তার বড় ছেলের এই পারিবারিক পবিত্ৰতা রক্ষার কর্তব্যপালন দেখে রেগে উঠে বলতেন, তোর অতো সব দিকে নজর দিয়ে বেড়াবার কী দরকার? যা বারণ করবার আমি করবো।
তুমি দেখলে তো কোনো ভাবনাই ছিল না— বলতো বড়দা, অম্লান বদনে মার মুখের উপরেই বলত, তা দেখতে তো দেখি না। বরং আমাদের ওপর টেক্কা দিয়ে মেয়েকে আস্কারা দেওয়াই দেখি। খু-ব মনের মতন মেয়ে কিনা!
মা চুপ করে যেতেন।
শুধু কখনো কখনো মায়ের চোখের মধ্যে যেন আগুনের ফুলকি জ্বলে উঠতো। তবু মা বকুলকেই কাছে ডেকে বলতেন, দাদা যা ভালবাসে না, তা দাদার সামনে কোরো না।
ছেলেবেলা থেকে মা বকুলদের শিখিয়েছেন, যা করবে সাহসের সঙ্গে করবে! লুকোচুরির আশ্রয় নিয়ে কিছু করতে যেও না। অথচ মা তাঁর বড় ছেলের তীব্র তিক্ত ব্যঙ্গের মুখটা মনে করে বলতেন, ওর সামনে কোরো না। বলতেন না, কোনো সময়ই কোরো না।
কিন্তু মা আর বকুলের ভাগ্যে কতোদিনই বা ছিলেন? মৃত্যুর অনেক দিন আগে থেকেই তো সংসারের দৃষ্টিতে মৃত হয়ে পড়েছিলেন। ছায়া দিতে পারতেন। কই?
তারপর তো প্রখর সূর্যালোকের নীচে, সনাতনী সংসারের জাঁতার তলায় বড়দার সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়ানো বকুলের।
অকারণেই হঠাৎ-হঠাৎ বলে বসতো বড়দা, ওদের বাড়ির জানলার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে কী করছিলি?…বলত-বারান্দায় দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে ইশারায় কথা হচ্ছিল?
অপরাধটা সত্যি হোক বা কাল্পনিক হোক, প্রতিবাদ করবার সাহস ছিল না বকুলের। বকুল শুধু মাথা হেঁট করে অস্ফুটে বলতো, কার সঙ্গে আবার, বাঃ!
বলতো, জানলার দিকে দাঁড়াতে যাবো কেন?
এর বেশী জবাব দেবার সাহস ছিল না বকুলের। বকুলের ভয়ে বুক টিপ টিপ করতো।
এ যুগের মেয়েরা যদি বকুলের সেই অবস্থাটা দেখতে পেতো, না জানি কতো জোরেই হেসে উঠতো।
অনামিকা দেবীর ভাইঝিটাই যদি দর্শক হত সেই অতীতের ছবির?
তা ও হয়তো হেসে উঠতো না।
ওর প্রাণে মায়া-মমতা আছে।
ও হয়তো শুধু মুখের রেখায় একটি কৃপার প্রলেপ বুলিয়ে বলতো, বেচারা!
তা শুধু ভাইঝি কেন, অনামিকা দেবীরও তো ওই ভীরু নির্বোধ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে-বেচারা! কী ভীরু! কী ভীরু!
কিন্তু ভীরু হওয়া ছাড়া উপায়ই বা কী ছিল বকুলের? কার ভরসায় সাহসী হবে? পাশের বাড়ির সেই ছেলেটার ভরসায়? অনামিকা দেবীর মুখে সূক্ষ্ম একটি কৃপার হাসি ফুটে ওঠে।
হাতে একবার হাত ছোঁয়ালে শীতের দিনে ঘেমে যেতো ছেলেটা। একটু ভালবাসা মত কথা কইতে গেলে কথাটা জিভে জড়িয়ে যেতো তার। আর জেঠিপিসির ভয়ে চোখে সর্ষেফুল দেখত।
তা জেঠি-পিসিদেরও তো ভীষণ ভাবে রাইট ছিল তখন শাসন করবার। নির্মল নামের সেই ছেলেটা তার দূর্দান্ত এক জেঠির ভয়ে তটস্থ থাকতো। জেঠির ঘ্রাণশক্তিটাও ছিল তীব্র। বিড়ালরা যেমন মাছ বস্তুটা বাড়ির যেখানেই থাকুক তার আঘ্রাণ পায়, জেঠিরও তেমনি বাড়ির যেখানেই কোনো অপরাধ সংঘটিত হোক তার আঘ্রাণ পেতেন।
অতএব নির্মলদের তিনতলার ছাতের সিঁড়ির ঘরটাকে অথবা সাতজন্ম ধুলো হয়ে পড়ে থাকা বাড়ির পিছন দিকের চাতালটাকে যখন বেশ নিশ্চিন্ত নিরাপদ ভেবে ওরা দুমিনিট দাঁড়িয়ে কথা বলছে, হঠাৎ জেঠির সাদা ধবধবে থানধুতির আঁচলের কোণটা ওদের চোখের সামনে দুলে উঠতো।
ওমা নির্মল তুই এখানে? আর আমি তোকে সারাবাড়ি গরু খোঁজা করে খুঁজে বেড়াচ্ছি!
ওই দুমিনিটের আগের মিনিটটায় নির্মল জেঠিমার চোখের সামনেই ছিল, মানে আর কি ইচ্ছে করেই চোখের সামনে ঘোরাঘুরি করে এসেছিল, যাতে তার অনুপস্থিতির পিরিয়ডটা অনেকক্ষণের ধূসবতায় ছড়িয়ে না পড়ে। তবু জেঠিমা ইতিমধ্যেই নির্মলকে গরুখোঁজা খুঁজে ফেলে বাড়ির এই অব্যবহৃত অবান্তর জায়গাটায় খুঁজতে এসেছেন!
কিন্তু খোঁজার কারণ?
সেটা তা অনুক্তই থেকে যায়।
জেঠিমার বিস্ময়োক্তিটাই যে শ্রোতা যুগলের বুকের মধ্যেটা ছুরি দিয়ে কেটে কেটে নুন দেয়।
ওমা! বকুলও যে এখানে? কতক্ষণ এলি মা? আহা মা-হারা প্ৰাণ, বাড়িতে তিষ্ঠোতে পারে না, ছুটে ছুটে পাড়া বেড়িয়ে বেড়ায়। আয় মা আয়, আমার কাছে এসে বোস।
অতএব মাতৃহীনা বালিকাকে ওই মাতৃস্নেহ-ছায়ায় আশ্রয় নিতে গুটিগুটি এগোতে হয়। নির্মল তো আগেই হাওয়া হয়ে গেছে, কোনো বানানো কৈফিয়তটুকু পর্যন্ত দেবার চেষ্টা না করে।