খিদে নেই বলে সামান্য একটু জল খেয়ে শুয়ে পড়লেন অনামিকা দেবী। বৌটি ওর মশারি গুঁজে দিতে এসে হঠাৎ বিছানার পায়ের দিকে বসে পড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আপনি এতো নতুন নতুন প্লটে গল্প লেখেন, তবু আপনাকে একটা প্লট আমি দিতে পারি।
শুনে অনামিকা দেবীর মনের মধ্যে একটু সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠলো। প্লট!
তার মানে আপন জীবনকাহিনী!
যেটা নাকি অনেকেই মনে করে থাকে আশ্চর্য রকমের মৌলিক, আর পৃথিবীর সব থেকে দুঃখবহ।
হ্যাঁ, দুঃখই।
সুখী সন্তুষ্ট মানুষেরা নিজের জীবনটাকে উপন্যাসের প্লট বলে ভাবে না। ভাবে দুঃখীরা, দুঃখ-বিলাসীরা।
বৌটিকে তো সারাদিন বেশ হাসিখুশি লাগছিল, কিন্তু হঠাৎ দেখলেন তার মুখে বিষণ্নতা, সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছে, আমি আপনাকে একটি প্লট দিতে পারি।
তবে দুঃখবিলাসী!
নিজের প্রতি অধিক মূল্যবোধ থেকে যে বিলাসের উৎপত্তি।
আমি আমার উপযুক্ত পেলাম না।
এই চিন্তা নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সমন্ত পাওয়াটুকুকেও বিস্বাদ করে তুলে এরা অহরহই দুঃখ পায়।
অনিলবাবুর ভাগ্নেবৌ।
কিন্তু মামাশ্বশুরের বাড়িতে থাকে কেন সে? তার স্বামী কোথায়?
এ প্রশ্ন অনামিকা দেবীর মনের মধ্যে এসেছিল, কিন্তু এ প্রশ্ন উচ্চারণ করা যায় না। তবু ভাবেননি হঠাৎ এক দীর্ঘশ্বাস শুনতে হবে।
শুনে না বোঝার ভান করলেন।
বললেন, আমাদের এই জীবনের পথের ধুলোয় বালিতে তো উপন্যাসের উপাদান ছড়ানো। প্রতিনিয়তই জমছে প্লট! এই যে ধর না, আজকেই যা ঘটে গেল, এও কি একটা নাটকের প্লট হতে পারে না?
নমিতা যেন ঈষৎ চঞ্চল হলো।
নমিতার এসব তত্ত্বকথা ভাল লাগলো না তা বোঝা গেল। অথবা শোনেওনি ভাল করে। তাই কেমন যেন অন্যমনস্কের মতো বললো—হ্যাঁ তা বটে। কিন্তু এটা তো একটা সাময়িক ঘটনা। হয়তো আবার আসছে বছর এর থেকে ঘটা করেই সাহিত্যসভা হবে। কিন্তু যে নাটক আর দুবার অভিনয় হয় না? তার কী হবে?
অনামিকা দেবী ঈষৎ চকিত হলেন। যেন ওই রোগা পাতলা সুশ্ৰী হলেও সাদাসিধে। চেহারার তরুণী বৌটির মুখে এ ধরনের কথা প্ৰত্যাশা করেননি।
আস্তে বললেন, তারাও কোথাও কোনো সার্থক পরিসমাপ্তি আছেই।
নাঃ, নেই।
নমিতা খাট থেকে নামলো।
মশারি গুজতে লাগলো।
যেন হঠাৎ নিজেকে সংযত করে নিলো।
অনামিকা দেবী মশারি থেকে বেরিয়ে এলেন। বললেন, এক্ষুনি ঘুম আসবে না, বোসো, তোমার সঙ্গে একটু গল্প করি।
না না, আপনি ঘুমোন। অনেক ক্লান্তি গেছে। আমি আপনাকে বকাচ্ছি দেখলে মামীমা রাগ করবেন।
বাঃ, তুমি কই বকাচ্ছ? আমিই তো বকবক করতে উঠলাম। বসো বসো। নাকি তোমারই ঘুম পাচ্ছে?
আমার? ঘুম? মেয়েটি একটু হাসলো।
অনামিকা দেবী আর ঘুরপথে দেরি করলেন না।
একেবারে সোজা জিজ্ঞেস করে বসলেন, আচ্ছা, তোমার স্বামীকে তো দেখলাম না? কলকাতায় কাজ করেন বুঝি?
নমিতা একটু চুপ করে থাকলো।
তারপর হঠাৎ বলে উঠলো, কলকাতায় নয়, কাজ করেন হৃষিকেশে। পরকালের কাজ। সাধু হয়ে গেছেন। বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
প্লটটা জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল অতএব।
যদিও এমন আশ্চর্য একটা প্লটের কথা আদৌ ভাবেননি অনামিকা দেবী।
ভেবেছিলেন সাংসারিক ঘাত-প্ৰতিঘাতের অতি গতানুগতিক কোনো কাহিনী বিস্তার করতে বসবে নমিতা। অথবা জীবনের প্রথম প্রেমের ব্যর্থতার। যেটা আরো অমৌলিক
প্ৰথম প্ৰেমে ব্যর্থতা ছাড়া সার্থকতা কোথায়?
কিন্তু নমিতা নামের ওই বৌটি যেন ঘরের এমন একটা জানলা খুলে ধরলো, যেটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত।
অনামিকা দেবী অবাক হয়ে ভাবলেন, সেই ছেলেটা যদি এতোই ইচড়ে পাকা তো বিয়ে করতে গিয়েছিল কেন?
ক দিনই বা করেছে বিয়ে?
এই তো ছেলেমানুষ বৌ!
আহা ওকে আর একটু স্নেহস্পর্শ দিলে হতো। ওকে আর একটু কাছে বসালে হতো!
ওকে কি ডাকবেন?
নাঃ, সেটা পাগলামি হবে। তা ছাড়া আর হয়তো একটি কথাও মুখ দিয়ে বার করবে না ও! কোন মুহূর্তটা যে কখন কী কাজ করে বসে!
এমনি হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া মুহূর্ত, হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যাওয়া মুহূর্ত এরাই তো জীবনের অনেকখানি শূন্য করে দিয়ে যায়।
আলোটা নিভিয়ে দিলেন।
জানলার কাছে এসে দাঁড়ালেন।
সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা দৃশ্য।
নিরন্ধ্র অন্ধকার, মাথার উপর ক্ষীণ নক্ষত্রের আলো। সমন্ত পটভূমিকাটা যেন বর্তমানকে মুছে নিচ্ছে।
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে বিছানায় এসে বসলেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তে বকুল এসে সামনে দাঁড়ালো। সেই অন্ধকারে।
অন্ধকারে ওকে স্পষ্ট দেখা গেল না। কিন্তু ওর ব্যঙ্গ হাসিটা স্পষ্ট শোনা গেল।
কী আশ্চর্য! আমাকে একেবারে ভুলে গেলে? স্রেফ বলে দিলে খাতাটা হারিয়ে ফেলেছি?
অনামিকা দেবী ওই ছায়াটার কাছে এগিয়ে গেলেন। বললেন, না না। হঠাৎ দেখতে পাচ্ছি, হারিয়ে ফেলিনি। রয়েছে, আমার কাছেই রয়েছে। তোমার সব ছবিগুলোই দেখতে পাচ্ছি।
ওই যে তুমি নির্মল নামের সেই ছেলেটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে, ওই যে তুমি তোমার বড়দার সামনে থেকে মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছ, ওই যে তোমার সেজদি পারুল আর তুমি কবিতা মেলানো-মেলানো খেলা খেলছো, ওই যে তোমার মৃত্যুশয্যাশায়িনী মায়ের চোখবোজা মুখের দিকে নিষ্পলক চেয়ে রয়েছ, সব দেখতে পাচ্ছি।
দেখতে পাচ্ছি মাতৃশোকের গভীর বিষণ্ণতার মধ্যেও তোমার উৎসুক দৃষ্টির প্রতীক্ষা। ওই মৃত্যুর গোলমালে দুটো পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গিয়েছে বেড়ে, বাঁধটা খানিক গেছে ভেঙে। বকুলের বড়দা তখন আর সর্বদা তীব্র দৃষ্টি মেলে দেখতে বসছেন না, বেহায়া বকুলটা পাশের বাড়ির ছেলেটার সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়েছে কিনা।
০৮. বকুলের বড়দাই
হ্যাঁ, বকুলের বড়দাই ওই গুরুদায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছিল। বকুলের বাল্যকাল থেকেই। বকুলটা কোনো ফাঁকে পিছলে সরে গিয়ে পাশের বাড়ির ছেলেটার মুখোমুখি হচ্ছে কিনা তা দেখার।