এখন ফিরে এসেছি।
গঙ্গার এই তরঙ্গের সামনে বসে বসে ভাবছি, আমরা কি এই চেয়েছিলাম?
এই মুক্তি?
তুই তো জানিস আমাদের মাতামহী সত্যবতী দেবীর কথা!
তিনি নাকি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সংসারের গণ্ডি ছেড়েছিলেন, বিয়ে জিনিসটা ভাঙবার নয় কেন? তিনি কি এখন কোনোখানে বসে তার প্রশ্নের অনুকূল উত্তর পেয়ে খুব খুশী হয়ে উঠছেন? দেখছেন, ওটা ভাঙবার কিনা এই প্রশ্নটাই আজ হাস্যকর হয়ে গেছে!
হয়ত বহু পুরনো, বহু ব্যবহৃত ওই বিয়ে প্রথাটাই আর থাকবে না পৃথিবীতে। হয়তো বকুল এই চিঠির পৃষ্ঠাটা ঠেলে রেখে নিজের প্যাডে চোখ ফেললো।
আর অভ্যস্ত দ্রুততায় লিখে চললো, কিন্তু তাতে কী? এমন একটা কাল ছিল, যখন ও প্রথাটা ছিল না। এখনো এই পৃথিবীতেই এমন জগৎ আছে, যেখানে এখনো বিয়ে প্রথাটা নেই, তারা স্রেফ জীবজগতের নিয়মে চলে।
অবশ্য কোনো একটা নিয়ম মেনেই চলে। সে তো পশুপক্ষী কীটপতঙ্গও চলে। স্ত্রী-পুরুষের নিগূঢ় আকর্ষণের বন্ধনটা কেউ এড়াতে পারে না।
পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো সভ্যতাই এ বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের পথ বাতলাতে পারেনি। ওটা থাকবে, এবং দেশ কাল আর পাত্রের সুবিধা অনুযায়ী নতুন নতুন ব্যবস্থা তৈরী হবে। সৃষ্টি হবে নতুন নতুন সভ্যতা।
নতুন মানুষরা তাকেই অনুসরণ করে চলবে। বলবে এইটা নির্ভুল।
গৌরববোধ করবে তখনকার বর্তমানের সভ্যতা নিয়ে, শিল্প নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে, সমাজনীতি রাজনীতি নিয়ে।
বলবে, দেখো এ অমর! এ অবিনশ্বর!
মহাকাল অবশ্যই অলক্ষ্যে বসে হাসবেন। ওটাই যখন তার পেশা।
একদা এই মানুষ জাতটা গুহা থেকে বেরিয়ে পড়ে নানান চেষ্টা শুরু করেছিল, শুধু বেঁচে থাকার চেষ্টা। আর কিছু না। শুধু ক্ষুধার নিবৃত্তি করে বেঁচে থাকা। ক্রমেই দেখল চেষ্টার অসাধ্য কাজ নেই। বড় খুশী হয়ে উঠলো। নিজের কৃতিত্বে মোহিত হলো মুগ্ধ হলো, অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে চললো। অবশেষে গুহা থেকে চাঁদে উঠলো।…আরো ছুটছে, ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। টের পাচ্ছে না তাদের চলার পথটা আবার গুহামুখো হয়ে যাচ্ছে!
যাবেই। যেতে বাধ্য। পথটা যে বৃত্তপথ।
তবু কালের হাতের ছোট্ট পুতুল এই মানুষগুলো তাদের ক্ষণকালের জীবনের সম্বলটুকু নিয়েই সামনে এগোচ্ছি বলে ছুটবে।
ছুটবে, ছুটোছুটি করবে, লাফাবে, চেঁচাবে, মারবে, মরবে, লোভে ডুববে, হিংসায় উন্মত্ত হবে, স্বার্থে অন্ধ আর রাগে দিশেহারা হবে।
নিজের দুঃখের জন্যে অন্যকে দোষ দেবে, আর সম্পদের জন্যে আপন মহিমার অহঙ্কারে স্ফীত হবে।
যে জীবনটার জন্যে সামান্যতম প্রয়োজন, তার প্রয়োজনের সীমানা বাড়াতে বাড়াতে আরো অধিকের পিছনে অজ্ঞানের মত ছুটবে, যে সোনার কণামাত্রও নিয়ে যাবার উপায় নেই জানে, সেই সোনার পাহাড় গড়ে তুলতে জীবনের সমস্ত শ্রেয়গুলিকে জলাঞ্জলি দেবে।
এরই মধ্যে আবার কিছু মানুষ চিৎকার করে বলবে, চলবে না। চলবে না। এসব চলবে না।
তবু চলবে। কিছু মানুষ গম্ভীর গলায় বলবে, ওটা ঠিক নয়, ওটা অন্যায়, ওটা পাপ।
যেন পাপপুণ্যের মাপকাঠি তাদের হাতে। যেন আজ যা চরম পাপ, আগামী কাল তা পরম পুণ্য হয়ে সভায় এসে আসন নেবে না। তবু চেষ্টা চালিয়ে যাবে তারা। ভাববে তাদের হাতেই নির্ভুল ছাঁচ।
তা বলে কি কোথাও কিছু নেই।
আছে।
তবু কোথাও কিছু আছে।
তবু কোথাও কিছু থাকে।
থাকবে।
একান্ত তপস্যা কখনো একেবারে ব্যর্থ হয় না।
তাই সুবর্ণলতাদের সংসারে শম্পাদের আবির্ভাব সম্ভব হয়। যারা সর্বস্বের মূল্যে প্রেমকে প্রতিষ্ঠিত করে জীবন পাবার দুঃসাহস রাখে।
অতএব মস্ত লেখিকা অনামিকা দেবী এখনো কোনো কোনো দিন, যেদিন জীবনের সব কিছু নেহাৎ অর্থহীন লাগে, ছেলেমানুষের মত রাত্রির আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রকে খোঁজেন, আর আরো ছেলেমানুষের মত অসহায় গলায় বলেন, দেখো, যে লেখা আগামী কালই জলের আলপনার মত মিলিয়ে যাবে, সেই লেখাই লিখলাম জীবনভোর,
–শুধু বকুলের কথাটা আর লেখা হলো না…তোমার আর বকুলের কথা।
কী লিখব বলো? তারা তো হার মেনে মরেছে। হার মানার কথা কি লেখা যায়? সেই হার মানার মধ্যে যে পাওয়া, তার কথা বলতে গেলে লোকে হাসবে। বলবে, কী অকিঞ্চিৎকর ছিল ওরা! তবে?
প্রত্যক্ষে যারা জিতেছে, এখন তবে তাদের কথাই লিখতে হবে।…
এখন তাই শম্পার কথা লেখা হলো। যে শম্পা খেটে খেটে রোগা হয়ে যাওয়া মুখে মহোৎসাহের আলো মেখে বলে, আমার নতুন সংসার দেখতে গেলে না পিসি? যা গুছিয়েছি দেখে মোহিত হয়ে যাবে। দক্ষিণের বারান্দায় বেতের মোড়া পেতে ছেড়েছি। আর তোমার জাম্বুবানকে তো প্রায় মানুষ করে তুলেছি। চাকাগাড়ি চড়িয়েই একবার সেজপিসির কাছে নিয়ে যাবো ঠিক করেছি।
–: সমাপ্ত :–