আহ্লাদের চাঞ্চল্য বড় বেশী চাঞ্চল্য বকুল, সেই আহ্লাদটা যেন নিজের মধ্যে বইতে পারছি না
এই সময়ে বউমা এ ঘরে এলো।
বলে উঠলাম, এইবার একটা পিয়নটিয়ন কাউকে বলে আমায় পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা কর বউমা। শোভন তো এখন বেশ ভালই আছে।
বকুল রে, বোকা বনে গেলাম ওর জবাব শুনে!
পারুলবালা কখনো জীবনে এমন বোকা বনেনি!
অথচ ও খুব সহজ ভাবেই বললে, ভাল আছে, তবে এখনো তো কিছুটা দেখাশোনার দরকার আছে। আপনিও চলে যাবেন?
আমিও চলে যাব!
এ আবার কি ভাষা!
বোকার মত বলে ফেললাম, খুব বোকার মত বলে ফেললাম, আমিও মানে?
রেখা বলল, আমি তো কাল চলে যাচ্ছি। ছুটি ফুরিয়ে গেল।
তারপর একটু হেসে বলল, আপনার তো আর ছুটি ফুরনোর প্রশ্ন নেই। আরো কিছুদিন থাকলে ভাল হত।
তবু এখনো পুরোটা বুঝতে পারিনি বকুল।
হয়ত অবচেতন মনের ইচ্ছেটাই পারতে দেয়নি।
চোখের সামনে প্রিয়জনের মৃত্যু ঘটলে সেটা নিশ্চিত দেখেও যেমন বার বার মনে হয়, ওই বুঝি বুকটা নড়ছে, ওই বুঝি নিশ্বাসের শব্দ হচ্ছে, তেমনি অবোধ প্রত্যাশাতেই ভাবলাম, হয়তো হঠাৎ চলে এসেছে বলেই একেবারে পদত্যাগপত্র দিয়ে আসতে পারেনি, তাই ছুটি ফুরনোর প্রশ্ন। অথবা হয়তো, এমনি হঠাৎ ছুটে চলে এসেছিল সঙ্কটাপন্ন অসুখের খবর শুনে, এসে দেখেছে কী ভুল করে দূরে বসে আছি।
ভালবাসার ঘরে ভালবাসার জনের কাছে নতুন করে বন্দী হয়ে গিয়ে আটকে গেছে। তবু সেখানকার ঋণটা শোধ করতে একবারও তো যেতে হবে।
তাই বললাম, ওঃ! তা কদিনের জন্যে যেতে হবে? সে ক’দিন তাহলে থাকবো!
রেখা আমার থেকে অনেক বেশী অবাক হয়ে বললো, ক’দিনের জন্যে মানে? এবার তো চলেই যাব!
চলে যাবে? এখান থেকে আবার চলে যাবে?
রেখা হঠাৎ খুব হেসে উঠল।
হয়তো কান্নাটাকে হাসিতে রূপান্তরিত করে ফেলবার কৌশল ও শিখে ফেলেছে।
বোধ হয় সেই হাসিটাই হেসে বললে, ওমা! আপনি কি ভেবে রেখেছেন আমি চিরকালের জন্যে এখানে থাকতে এসেছি? হঠাৎ অসুখ শুনে–
বললাম, হঠাৎ অসুখ শুনে থাকতে না পেরে ছুটে চলে আসাই তো “চিরকাল থাকবার” ইশারা বউমা! একবার ভুল করেছে তোমরা, আর ভুল করো না। এটাই তোমার চিরকালের জায়গা, চিরকালই থাকবে।
ও আমার মুখের দিকে একটু তাকিয়ে বলল, কী যে বলেন।
বেশ অবলীলায়ই বললো।
আর কিছু বলে উঠতে পারলাম না বকুল। এই অবলীলার কাছে কী কাকুতি-মিনতি করবো! কোন্ ভাষায়!
শোভনের কাছে গিয়ে বসে পড়লাম।
বোধ হয় কেঁদে পড়লাম বললেই ঠিক বলা হতো। যা পারুলবালার জীবনে কখনো ঘটেনি।
বললাম, শোভন কী বলেছিস তুই বউমাকে?
তারপর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম।
দেখে অবাক হয়ে গেলাম।
এই মুখটা আবার কোথায় ফিরে পেল ছেলেটা, যে মুখটা প্রথম দিন এসে দেখেছিলাম। এ যেন সেই মুখ। সেই কালি পড়া শুকনো। হঠাৎ পাওয়া লাবণ্যটুকু কোথায় গেল? এত আকস্মিক এমন চলে যেতে পারে?
ওর মুখের সামনে এখনো খবরের কাগজখানা।
প্রায় আড়াল থেকেই শুকনো গলায় বললো, আমি কি বলবো?
রেগে গেলাম। বললাম, সামনে থেকে আড়াল সরা! স্পষ্ট চোখে চেয়ে বল, কিছু বলিসনিই বা কেন? কেন বলিসনি, তোমার যাওয়া চলবে না?
শোভন বললো, যা হয় না, তা হওয়ার চেষ্টাটা পাগলামি!
এইটাই সুস্থতা? বললাম, তোর অসুখ শুনে রেখা কী ভাবে ছুটে এসেছিল তা দেখতে পেলি না তুই? তোর কি চোখ নেই? ভালবাসা চিনতে পারলি না?
ও কি বললো জানিস?
বললো, চিনতে পারলেই বা কি? সকালের ওপর হচ্ছে প্রেস্টিজ। যে জিনিসটা ভেঙে গেছে বলে সকলের সামনে ফেলে দিয়েছি, সেটাকে তো আর আবার সকলের সামনে তুলে নেওয়া যায় না!
কেন নেওয়া যায় না? শুধু ওই সকলের কাছে ধরা পড়ে যাওয়া–আমরা ভুল করেছিলাম, এই তো! আর কি? ওটা কে ক’দিন মনে রাখবে শোভন? কে কার কথা নিয়ে বেশিদিন মাথা ঘামায়? এই সকল দুদিন বাদে ভুলে যাবে। আমি বলছি শোভন, তুই ওই একটা মিথ্যে একটু ‘প্রেস্টিজে’র অহঙ্কারে আবার ভুল করিসনি। তুই ওকে বল!
শোভন আমার দিক শোকে চোখ সরিয়ে নিয়ে দেয়ালে চোখ রেখে বললো, প্রেস্টিজটা একা আমারই নয় মা। তবু বলেছিলাম।
বলেছিলি? শোভন, কী জবাব দিল ও?
শোভনও তখন একটু হেসে উঠল। হেসে বলল, জবাবই দিল। বললো, আর হয় না।
আর হয় না! আর হয় না!
মৃত্যুর কাছে যেমন অসহায়তা, যেমন নিরুপায়তা, এ যেন তেমনি। ওদের নিজের হাতের দণ্ডই ওদের কাছে মৃত্যুর মত অমোঘ।
অতএব রেখা এই সংসারকে গুছিয়ে দিয়ে যাবে, রেখা তার নিঃসঙ্গ স্বামীর কোথায় কী অসুবিধে সেটা নিরীক্ষণ কবে দেখে তার সাধ্যমত প্রতিকার করে যাবে, রেখা বাকি জীবনটা কান্নাকে হাসিতে রূপান্তরিত করে হেসে হেসে পৃথিবীতে বেড়াবে, আর শোভন নামের ছেলেটা অনুশোচনা নামের চাপা আগুনে তিল তিল করে পুড়ে তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে যাবে, জীবনের সব আকর্ষণ হারাবে আর ত্যশাস্তু যণায় ছটফটাবে! তবু কেউ ভাববে না, এত নিৰুপায়তা কেন? উপায় তো আমাদের হাতেই ছিল। আমাদের হাতেই আছে! কারণ আমাদের ভালবাসাটা আছে। সেটা মরে যায়নি।
ভাবতে পারতো যদি ওদের সে সাহস থাকতে, থাকতো সে শক্তি! যে শক্তিতে ওই সকলের চোখকে অবহেলা করা যায়!
তার মানে কেউ কোথাও এগোয়নি বকুল, এগোচ্ছে না। আমরাও যেখানে ছিলাম, এরাও সেখানেই আছে।
রেখা চলে গেল। আমিও আর কয়েকদিন ছিলাম। বসে বসে ছেলেটার যন্ত্রণার মুখ দেখলাম, যে যন্ত্রণার ছায়া দেখেছি রেখার মুখেও।