যা ক্ষতি, সে ক্ষতি ব্যক্তি-মানুষের। যা লাভ-লোকসান সে জনাকয়েক লোকের। তারা যেমনটি চেয়েছিল পেল না, যে জীবনের স্বপ্ন দেখেছিল সেটা হলো না, সেটা ভেঙে গুঁড়া হয়ে গেল। শুধু এই। তার বেশি কিছু নয়। সেই ধ্বংসের ওপর আবার নতুন ফসল ফলে, আবার নতুন গ্রাম শহর গড়ে ওঠে।
আমরা আপন কল্পনায় সমাজের একটা ছাঁচ গড়েছিলাম। আমাদের সর্বাঙ্গের শৃঙ্খল যেখানে যেখানে অসহনীয় যন্ত্রণায় পীড়িত করেছে, সেখানটায় বন্ধন শিথিল করতে চেয়েছিলাম, ভেবেছিলাম এই শেকলে নাটবন্টু কা স্কু এগুলো একটু আলগা হোক, কিন্তু আমাদের চাওয়াই তো শেষ চাওয়া নয়। আরো চাওয়ার পথ ধরে ওই শুকজা, নাটবগুলো খুলে খুলে ছিটকে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে।…যাবেই। কারণ আর এক নতুন ছাঁচ জন্মাবার অপেক্ষায় রয়েছে।
এইভাবেই এই অনন্তকালের পৃথিবীর অফুরন্ত জীবজগৎ মহাকালের খাজনা যুগিয়ে যাচ্ছে। তারা ভাবছে চেষ্টা করছে, প্রত্যাশা করছে, তপস্যা করছে, লড়াই করছে, তারপর কোথায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
তাই এক যুগে যা নিভুল ছাঁচ-পরবর্তী যুগে তা ভুলে ভর্তি। ক চিন্তাবিদের চিন্তার ফল, বহু কল্যাণকামীয় কল্যাণ চেষ্টা, আর বহু তাপসের তপস্যার ফল যে সমাজব্যবস্থা, তাকে দেখে দেখে পরবর্তীকাল ব্যঙ্গ করে, বিক্রপ করে, অবজ্ঞা করে।
ভাবে কি বোকা ছিল ওরা! কী মুখ্যু!
তবু সমাজ চিরদিনই জীবন নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে যাবে। কারুর চাওয়ার ধার পারবে না।
চিঠিই হয়তো লিখছে বকুল। তার সেজদি পারুলের চিঠির জবাব।
না হলে সামনের খোলা চিঠির পাতা ওল্টানো কেন? ওপিঠে যা লিখেছে পারুল, সেটা আবার একবার দেখতে বসলো কেন?
ভুল করে হয়তো উল্টো পিঠটা উল্টেছে বকুল, তাই আগের কথাগুলোর সঙ্গে যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছে না।
পারুল সব সময় ধরে ধরে পরিষ্কার করে লেখে, এখনো এই উত্তাল প্রশ্নেও তার হাতের লেখায় দ্রুতোর ছাপ তেমন নেই, যেমন থাকে বকুলের লেখায়। অনামিকা দেবী হয়ে অনেক লিখতে হয় বকুলকে, তাই ও যখন বকুলের কথা লিখতে বসে, তখন দ্রুততা আর ব্যস্ততার ছাপ।
পারুলের বাইরের জীবন চিরদিনই শান্ত ছন্দে আবর্তিত। শুধু পারুলের ভিতরের জীবন চির-অশান্ত।
তবু পারুল মুক্তোর মত অক্ষর লিখতে পারে। লিখেছে—
একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে গেল কিছুদিন আগে। তোকে ছাড়া আর কাকে বলব!
হঠাৎ খবর পেলাম শোভনের ভয়ানক অসুখ, অফিসে হঠাৎ চৈতন্য হারিয়ে চেয়ারেই পড়ে গিয়েছিল, হসপিটালে নিয়ে গেছে। অফিসেরই একটি চেনা ছেলে, আমি যখন একবার গিয়েছিলাম, মাসিমা, মাসিমা করত, খবরটা সে-ই পাঠিয়েছে।
বুঝতেই পারছিস, কী অবস্থায় কী ভাবে ছুটে গিয়েছি!
গিয়ে দেখি হাসপাতাল থেকে বাড়িতে এনেছে।
আর দেখলাম রেখা সেবা করছে।
খবরটা ওকেও দিয়েছিল।
আমার ছুটে চলে যাবার জন্যে তো সঙ্গী যোগাড় করতে হয়েছিল, তার জন্যে যেটুকু দেরি হয়েছিল, ওর তো তা হয়নি। ও নিজেই চলে গেছে।
মানের অগোচর পাপ নেই বকুল, সেই প্রায়-অচৈতন্য ছেলেটাকে দেখেও আমার মন বলে উঠল, ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্য করেন, এ কথাটা কোনোদিন বিশ্বাস করতাম না, আজ করলাম। শোভনের এই মৃত্যুতুল্য অসুখই শোভনকে আবার জীবনের স্বাদ ফিরিয়ে দিল। অসুখের বদলে আবার সুখ ফিরে পেল শোভন।
মাতৃহৃদয়ের আকুলতা নিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু মাতৃ-অধিকারের দাবি নিয়ে ছেলের শিয়রে বসতে গেলাম না। বহিরাগতের মতই শুধু কাছে একটু বসলাম, শুধু বউকে জিজ্ঞেস করলাম, কী অবস্থা, কী ওষুধ খাচ্ছে, ডাক্তার কী বললে, আবার ডাক্তার কখন আমাবে। জিজ্ঞেস করলাম ক’দিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। জিজ্ঞেস করিনি-তুমি কবে এলে, কখন এলে?
যেন ও আছে।
যেমন বরাবর ছিল।
ওর আসনে গিয়ে ও যখন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন আর কেন মনে পড়িয়ে দিই, একদিন তুমি স্বেচ্ছায় এ আসন ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলে!
শোভনের তৃষিত দৃষ্টি যে সব সময় বউকেই খুঁজছে, এ নিয়ে মনে কোনো অভিমান জমে ওঠেনি বকুল, জমে ওঠেনি কোনো ক্ষোভ।
মনে হয়েছিল, বাচলাম। আমি বাঁচলাম।
ভালবাসার সত্যি চেহারা দেখে বাচলাম। বাঁচলাম বউমাকে আবার চাকর-চাকরকে বকতে দেখে, বাড়ি অগোছালো করে রেখেছে কেন বলে। বাঁচলাম বৌমা আবার রান্নাঘরে ভাড়ারঘরের কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে।
শোভনের যা কিছু খাওয়ার দরকার বউমাই করে, এবং এমন নিপুণ ভাবে করে যে স্বীকার করতে লজ্জা হয় না, আমার দ্বারা এর সিকিও হতো না।
আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠছিল লোভন, ওর মুখে নতুন স্বাস্থ্যের ও লাবণ্যের সঙ্গে যে আশা আর আনন্দের লাবণ্য ফুটে উঠেছিল সেটা দেখে বর্তে যাচ্ছিলাম।
বুঝলাম, বউয়ের আসা, দুজনের মধ্যেকার ভুল-বোম্বাবুঝির অবসান, এটাই ওর পক্ষে মৃতসঞ্জীবনীর কাজ করেছে।
ভাবলাম এবার পালাই।
বেশী স্বাদ পাবার লোভে কাজ নেই। শুধু সেই হতভাগা ছেলেটাকে বোডিং থেকে আনবার কথা বলে যেতে পারলেই
সেদিন শোভন বেশ ভাল আছে, ভাবলাম এইবার বলি। যেতে গিয়ে দেখি বিছানায় বসে কাগজ পড়ছে শোভন, বউমা কাছে চেয়ারে বসে, শোভনেরই বোধ হয় জামার বোতাম বসাচ্ছে।
চলে এলাম।
ছন্দভঙ্গ করতে ইচ্ছা হল না। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালাম।
খানিক পরে এঘরে এসে দেখি বউমা শোভনের আলমারি খুলে যত পোশাক বার করে রোদে দিয়েছে, আলমারির দেরাজ খোলাটোলা।