যখন অপূর্ব তার স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে রান্নাঘর আলাদা করে ফেলেনি তখন শম্পা আর ওই মেয়েটা একসঙ্গে খেয়েছে, একত্রে বসেছে।
এতদিন শম্পা অনুপস্থিত ছিল, জানতে পারেনি ওদের ওই কাঁচের পার্টিশান দেওয়া ঘরের আড়ালে কী ঘটেছে, সে ঘটনা কোন্ পরিণতির দিকে এগোচ্ছে।…আজ এইমাত্র এসে চরম পরিণতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কিছু ভাববার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে শম্পা, শুধু আচ্ছন্ন হয়ে তাকিয়ে আছে।
আর এ-বাড়ির আর একজন সদস্যা?
অলকা নামের ওই প্রগতিশীল মহিলাটির কাছে যে নাকি চিরদিন ব্যঙ্গের পাত্রী?
সেই লেখিকা বকুল?
এ-বাড়িতে যে বেমানান, এ-বাড়িতে যে নিজেকে গুটিয়ে রাখার ভূমিকাতেই অভ্যস্ত?
তা তাকেও এখানে আসতে হয়েছে বৈকি।
সম্পর্কের দায়ে নয়, হৃদয়ের সায়েই।
বকুলেরও মনের মধ্যে কোনটায় যেন চিনচিন করছে।
আমরা মেয়েটাকে তাকিয়ে দেখিনি। আমরা আমাদের কর্তব্য করিনি। ওকে ওর ওই নির্বোধ আর আধুনিকতার বিকারগ্রস্ত মায়ের হাতে সমর্পণ করে রেখে দিয়েছি। ওর এই পরিণামের ভয়াবহ আশঙ্কা কি আমাদের মনের মধ্যে উঁকি মারেনি?
মেরেছে।
তবু আমরা ওর ছাগল ও যেদিকে ইচ্ছে কাটুক বলে দায়িত্ব এড়িয়ে বসে থেকেছি। সেই ভয়াবহতাই এসে চিলের মত ছোঁ দিয়ে নিয়ে গেল মেয়েটাকে।
আর কিছু করার নেই। ভুল সংশোধনের আর কোনো উপায় নেই।
না আমাদের, না ওর মার। কিন্তু ওর বাপই কি নির্দোষ?
সে কি তার কর্তব্য করেছে? নাকি একটা নিষ্ঠুর হিংস্রতায় বসে বসে অপেক্ষা করেছে কবে ওর মার দর্পচূর্ণ হয়?
অসম্ভব…এ হয়তো অসম্ভব, তবু চুপ-করিয়ে দেওয়া অলকা মাঝেমাঝেই বাঁধ ভেঙে কথা বলে উঠেছে। তীব্র অভিযোগের কথা, জানি জানি, খুব আহ্লাদ আজ তোমার! আজ তোমার শত্রুর হার হয়েছে। বরাবর তুমি আমায় শাসিয়েছে, এত বাড়াবাড়ির প্রতিফল একদিন পাবে। পেলাম সে প্রতিফল। এখন আহ্লাদ হবে না তোমার? লড়াইয়ে জেতার আহ্বাদ?
বকুল এগিয়ে আসে।
যে বৌটা চিরদিনই ঔদ্ধত্যের সঙ্গে তার কথাকে নস্যাৎ করে এসেছে, তাকেই দৃঢ়স্বরে বলে, এসব কী কথা হচ্ছে অলকা?…শুধু তোমারই কষ্ট হচ্ছে? অপুর হচ্ছে না?
অলকা মুখ তুলে লাল-লাল চোখে বলে, উপদেশ দিতে এসেছেন? দিন পেয়েছেন, তার সদ্ব্যবহার করছেন? করবেন বৈকি। তবে এ দিন আপনাদের পেতে হতো না। ওই যে নিষ্ঠুর লোকটা, যার দুঃখে সহানুভূতি আসছে আপনার, তার জন্যেই এই “দিন” পাওয়া আপনাদের। আমি আপনাদের ওই পচা সমাজকে মানতাম না, আমি কলঙ্ককে কেয়ার করতাম না, শুধু ওর ভয়ে–হ্যাঁ, শুধু ওর ভয়েই খুকু আমার
বকুল আস্তে আস্তে সরে গেল।
ওই অনুতাপে জর্জরিত বিকারগ্রস্ত মানুষটা এখন প্রায় পাগলের সামিল। ওর কথায় কান দেওয়া চলে না।
এখন উদ্ধার হতে হবে এই বিপদ থেকে। এ মৃত্যু শোকের পবিত্রতা নিয়ে আসেনি, এসেছে বিপদের ভয়াবহতা নিয়ে।
বকুল বাইরে এসে ডাকল, ‘ছোড়দা!’
যা করবার ওই ছোড়দাকেই করতে হবে।
তারপর বকুল দালানের এধারে, যেখানে উঁচু দেয়ালে এ-বাড়ির প্রাক্তন কর্তা প্রবোধচন্দ্র আর তার গৃহিণী সুবর্ণলতার ছবি টাঙানো আছে, সেধারে চলে এল।
সেদিকে তাকিয়ে রইল না, অন্য আর এক দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো, মা, তুমি কি অহরহ এই মুক্তিই চেয়েছিলে? এই শৃঙ্খলমুক্তি? তোমার প্রাণ কুড়ে চাওয়ার ফল কি এই?
৩৮. সুবর্ণলতার আরো একটা আত্মজা
বকুলের এ প্রশ্নের প্রতিধ্বনি উঠেছে সুবর্ণলতার আরো একটা আত্মজার কণ্ঠে।…কিন্তু এইটাই কি চেয়েছিলাম আমরা? আমি, তুমি, আমাদের মা দিদিমা, দেশের অসংখ্য বন্দিনী মেয়ে? এটাই কি সেই স্বাধীনতার রূপ? যে স্বাধীনতার জন্যে একদা পরাধীন মেয়েরা পাথরে মাথা কুটেছে, নিরুচ্চার আর্তনাদে বিধাতাকে অভিসম্পাত করেছে? এ কি সেই মুক্তির আলো, যে মুক্তির আশায় লোহার কারাগারে শৃঙ্খলিতা মেয়েরা তপস্যা করেছে, প্রতীক্ষা করেছে?..না বকুল, এ আমরা চাইনি।
বকুলের সামনে টেবিলের ওপর যে খোলা চিঠিটা পড়ে রয়েছে, তার উপর পৃষ্ঠার এই কটা লাইনের দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রয়েছে বকুল। যেন অক্ষর গুনে গুনে পড়ছে।
তারপর কলমটা তুলে নিল, নিল প্যাডটা। লিখতে লাগল আস্তে আস্তে।
কে জানে ওই চিঠিটারই জবাব দিচ্ছে, না নিজের প্রশ্নেরই জবাব খুঁজছে।
কিন্তু আমাদের চাওয়া নিয়েই কি পৃথিবী চলবে? এই অনন্তকালের পৃথিবী কখনো কি কারুর চাওয়ার মুখ চেয়ে চলেছে, চলার পথ বদল করেছে, অবহিত হতে থমকে দাঁড়িয়েছে?…প্রকৃতি তার অফুরন্ত সম্পদের ডালি নিয়ে যে ঋতুচক্রে আবর্তিত হচ্ছে, সে কি কারো চাওয়ার ওপর নির্ভর করে?..জগতে যা কিছু ঘটে চলেছে, সে কার ইচ্ছায়? যা কিছু অসঙ্গতি, যা কিছু ভালমন্দ, কার তপস্যায়, কার মাথা কোটায়? কারুর নয়, কারুর নয়, মানুষের ভূমিকা কাটা সৈনিকের।
আমরা ভেবে মরছি–আমি করছি, তুমি করছছ, ওরা করছে, এরা করছে, কিন্তু সেটা কি সত্যি?
পৃথিবী তার আপন নিয়মে চলে, প্রকৃতি তার আপন নিয়মে চলে, সমাজও তার আপন নিয়মে চলে। মানুষ সেখানে নিমিত্ত মাত্র। তবু মানুষ বদ্ধপরিকর হয়ে সংকল্প করে, এটাকে আমি নিয়ন্ত্রণ করবো। তাই অহরহই তোড়জোড়, অহরহই তাল ঠোকা আর অহরহই মাথা ঠোকা। ওই তাল ঠোকার দল আপন বুদ্ধির অহঙ্কারে সমাজের একটা ছাঁচ গড়ে ফেলে সেটাকেই চালাতে চায়, আর না চললে আর্তনাদ করে মরে, গেল গেল, সব রসাতলে গেল। যেমন বন্যায় যখন গ্রাম, নগর, ফসলের ক্ষেত ডোবে, আর্তনাদ ওঠে–গেল, সব গেল! কিন্তু ও আর্তনাদে মহাকালের কিছু যায় আসে না, পৃথিবীর কোথাও কোনো ক্ষতচিহ্ন থাকে না।