ওই নিষ্ঠুর হৃদয়হীন লোকটা অলকাকে শাসন করতে এসেছিল, বলেছিল, চুপ! একদম চুপ করে থাক! এতদিন আমি চুপ করে থেকেছি, এবার থেকে তোমার পালা!
কিন্তু পারেনি অলকা নামের ওই অতি আধুনিকা হবার চেষ্টায় বিকৃত হয়ে যাওয়া মানুষটা। যে নাকি ওই সুবর্ণলতার বংশধরের বৌ। রাজেন্দ্রলাল স্ট্রীটের এই বাড়িটার খানিকটা অংশে যার আইনসঙ্গত অধিকার।
হ্যাঁ, সেই আইনসঙ্গত অধিকারের বলেই অলকা তার পেন্ট-করা মুখ আর রং লাগানো ঠোঁট বাঁকিয়ে বলত, আমার ঘরে আমি যা খুশি করবো, কারুর কিছু বলতে আমার অধিকার নেই। বেশ করবো আমার মেয়েকে আমি নাচাবো গাওয়াব, সমাজে ছেড়ে দেবো..এ বাড়ির এই ঘূণ-ধরা দেওয়ালের খাজে খাজে যে সনাতনী সংস্কার এখনো বসে আছে আর এ সংসারের জীবনযাত্রার ওপর চোখ রাঙাতে আসছে, তাকে আমি মানি না, মানবো না। তোমরা হচ্ছে কূপমণ্ডুক, তোমাদের কাছে অগ্রসর পৃথিবীর খোলা হাওয়া এসে ঢোকে না। …তোমাদের বাড়িতে নাকি এক প্রগতিশীল লেখিকা আছেন, আন্ততঃ শুনতে পাই বাইরের জগতে পাঠকসমাজে তার নামের ওই বিশেষণ, কিন্তু আমি তো তার প্রগতির কোনো চিহ্নই দেখি না। তিনি তোমাদেরই মত সংস্কারে আচ্ছন্ন।…না হলে আমাকে এত লড়তে হতো না, আমি একটু অনুকূল বাতাস পেতাম।…আমি কোনো আনুকূল্য পাইনি কারো কাছে, সারাজীবন। প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে নৌকাকে কূলের দিকে নিয়ে চলেছি। এমন কি তুমি স্বামী, তুমিও আমার প্রতেকটি কাজ প্রত্যেকটি বাপার অপছন্দর দৃষ্টিতে দেখে এসেছে। কোনোদিন সাহায্য সহায়তা করনি। তবু দেখো, আমি কি হেরে গেছি? না হার মেনেছি?.না, হার আমি মানাবো না। আমার জীবনে যা পাইনি, আমি যে জীবন পাইনি, সেই জীবন, সেই পাওয়া আমার মেয়েকে আমি দেবো।
প্রায় এইরকম নাটকীয় ভাষাতেই কথা বলে এসেছে অলকা এযাবৎ অপূর্ব চুপ করে। থেকেছে, চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়েছে। প্রতিবাদ তুললেই অলকা এমন ঝড় তোলে যে বাড়িতে মানসম্মান বজায় থাকে না।
অথচ আজকালকার দিনে এই রাস্তার ওপরকার বাড়ির ভাগ ছেড়ে দিয়ে মানসম্মান নিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়াও সহজ নয়।
তাই চুপ করে থাকতে হয়েছে অপূর্বকে। এবং অলকা ওই চুপ করিয়ে রাখার আত্মপ্রসাদে ডগমগ করতে করতে একটা অজানা জগতের দিকে অন্ধের মত ছুটেছে। সেই ছোটাটার বাহন তার মেয়ে। যে মেয়েটা এখন জবাব দিয়েছে।
নয়া, আর কোনোদিন তাকে নিয়ে ছুটতে পারবে না অলকা।
এখন তাই অপূর্বর দিন এসেছে।
কথা বলার দিন।
আগুনের ডেলার মত দুই চোখে ওই শোকাহতার দিকে তাকিয়ে নির্মায়িকের মত বলেছে চুপ! চুপ! চুপ করে থাক! টু শব্দ নয়।
কিন্তু সে শব্দ তো করেই বসে আছে তার আগে অলকা। মাতৃহৃদয় কি একবারও হাহাকারে ফেটে না পড়ে পারে?
অলকা আত্মগ্লানিতে হাহাকার করে উঠে বলেছে, আমি কী করলাম! আমি কী করলাম আমি লোকলজ্জার ভয়ে আমার সোনার খুকুকে হারালাম! ওরে খুকু, কেন আমি তোর নিষ্ঠুর বাপকে ভয় করতে গোলাম! কেন তোকে নিয়ে এদের সংসার ছেড়ে চলে গেলাম না!
তারপর আর বলতে পায়নি অলকা।
চিরদিনের মুখরা ওই মেয়েটাকে চিরদিন চুপ করে থাকা মানুষটা চুপ করিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু তাতে আর কী লাভ হলো?
ওই একবারের হাহাকারেই তো সংসারসুদ্ধ নোক জেনে ফেলেছে ঘটনাটা কী। জেনে ফেলেছে ঝি-চাকরেরাও। অতএব পাড়ার লোকেও জেনে ফেললো বলে।
এ সংসারের অন্য সদস্যরা সাধ্যপক্ষে অলকার ঘরের সামনে এসে দাঁড়াত না। অলকার ঔদ্ধত্য, অলকার স্বেচ্ছাচার, অলকার বিশ্বনস্যাৎ ভাব সকলকেই দূরে সরিয়ে রাখতে।
কিন্তু আজ আর অলকার সে গৌরব নেই। আজ অলকার মুখের রং গেছে মুছে, চোখের কাজল গেছে ধুয়ে, উদ্ধত উচ্চচূড়া খোঁপাটা গেছে ভেঙে লুটিয়ে, অলকা পরাজিতের চেহারা নিয়ে পড়ে আছে।
তবে আর আসতে বাধা কি?
একটি বিধবা কন্যার আর একটি মৃত কন্যার সন্তানসন্ততিকুল নিয়ে এবং বাতের যন্ত্রণা নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন মেজ জেঠি স্বয়ং, যিনি অলকার মুখই দেখতেন না। এসেছেন বড়গিন্নী তার জ্বালাভরা প্রাণ নিয়ে। ছেলের বৌ কোনোদিনই তাকে মানুষ বলে গণ্য করতো না, গুরুজন বলে সমীহ করতো না, তিনিও তাই ওই ভিন্ন হয়ে যাওয়া ছেলে, ছেলের বৌয়ের ছায়াও মাড়াতে আসতেন না।
কিন্তু আজকের কথা স্বতন্ত্র।
আজ ওই প্রতিপক্ষের সকল দর্প চূর্ণ।
যাকগে নিজের প্রাণ ফেটে, তবু তিনি মনের অগোচরে নিরুচ্চার উচ্চারণে বলে বসেছেন, হে নারায়ণ, দেখলাম “দর্পহারী” নামই তোমার আসল নাম!
ঘরের একাংশে কোণের দিকে ছায়ার মত দাঁড়িয়ে আছে শম্পা আর তার মা-বাবা…যে শম্পা বহুদিন পরে আজই প্রথম আবার এ-বাড়িতে এসে আহ্লাদে বেদনায়, বিস্ময়ে, কৌতূহলে চারিদিকে তাকিয়ে দেখছিল। সহসা উঠলো ওই আর্তনাদ বাতাস বিদীর্ণ করে।
আমি কী করলাম! আমি কী করলাম!
ভগবান, তুমি কী করলে! তুমি কী করলে! এ শোকের সান্ত্বনা আছে! আমি কী করলাম! এ শোক সান্ত্বনার বাইরের।
শম্পা অবাক হয়ে যেন নিজের ভাগ্যও দেখছিল। এতদিন কিছু হলো না, ঠিক আজই ঘটলো এই দুর্ঘটনা!
শম্পা একটা অদ্ভুত বিষাদ-বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওই নীল-হয়ে-যাওয়া মেয়েটার স্তব্ধ দেহটার দিকে তাকিয়ে।
ওই মেয়েটা শম্পার আশৈশবের সঙ্গিনী নয়, চিত্তজগতের সখী নয়, এমন কি সম্পর্কসূত্রে যে বন্ধনটুকু থাকা উচিত সে বন্ধনেরও গ্রন্থি ছিল না পরস্পরের মধ্যে। তবু তারা দুজনে প্রায় সমবয়সী, দুজনে একই ছাদের নীচে থেকেছে জন্মাবধি …