তার জন্যে এতো কৈফিয়ৎ দেবার কী আছে? কী লিখেছে? ভাল আছে তো?
ভাল? হা–ভাল আছে বৈকি।
মানুর গলার স্বরে বিদ্রুপের ছায়া।
রমলার নিয়ম ছেলের চিঠি এলে তাড়াতাড়ি চোখ বুলিয়ে নিয়ে পরে বসে ধীরেসুস্থে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া। যত সংক্ষিপ্ত চিঠিই হোক বার বার না পড়লে যেন হয় না রমলার।
আজ কিন্তু ওই চোখ বুলিয়ে নিয়েই বসে পড়ে রমলা, দ্বিতীয়বার আর পড়তে পারে না। রমলার মুখটা সাদা দেখায়।
তোমার দিব্যি দেওয়ার প্রতিক্রিয়া
মানু তেমনি বিদ্রূপ আর হতাশার স্বরে বলে, আমি জানতাম। এই রকমই যে একটা চিঠি আসবে এ আমার ধারণা ছিল। তা যাও ছেলের নেমন্তন্নে ছেলের বাড়ি ঘুরে এসো। কত বড় আশ্বাস দিয়েছে–রাহা খরচ পাঠাবে! এই ছেলের কাছে তুমি কাঁদুনি গাইতে গেছলে? মান রাখলো তার?
রমলা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে আস্তে বলে, সে দেশটা এতো ভালো লেগে গেল তার যে, জন্মভূমিতে একবারের জন্যেও আসতে ইচ্ছে করছে না?
ও পক্ষ থেকে এর আর কোনো উত্তর এলো না।
রমলা আবার বললো, সেখানে বাড়ি কিনেছে, গাড়ি কিনেছে, সে দেশের নাগরিক হয়ে বসেছে, তাহলে বিয়েটাই কি করতে বাকি আছে?
না থাকাই সম্ভব।
আমার দু-দুটো সন্তানকেই হারিয়ে ফেললাম! বিদেশে পড়তে না পাঠালে এমন হতো না
শম্পাকে আমরা বিদেশে পড়তে পাঠাইনি!
ওর কথা আলাদা, ওকে তুমি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলে! ওর খবর পেয়েও চুপ করে বসে থেকেছ!
রমলাও যে ওই অপরাধের শরিক তা মনে পড়িয়ে দেয় না তার স্বামী। এখনো তেমনি চুপ করে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে থাকে।
হয়তো মনে মনে ভাবে, আমি আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে গেলাম না, এই দুঃখ!
এই কথা ভাবেনি, প্রায়শ্চিত্ত করবার সুযোগ তখুনি এসে যাবে।
এলো এক অদ্ভুত যোগাযোগ।
নইলে পুলক সঙ্ঘের সেই ছেলের দলের একজন তাদের স্মারক পুস্তিকাখানা আজই অনামিকা দেবীকে দেবার জন্য আসবে কেন? আর ঠিক সেই সময়টাতেই তাদের অনামিকা দেবী বাড়িতে অনুপস্থিত থাকবেন কেন?
অবশ্য এমন অনুপস্থিত তো বারো মাসই থাকে বকুল। ছেলেটা শুধু বইখানা দিয়েই চলে গেলে কিছুই ঘটতো না। কিন্তু ঘটতেই হবে যে।
লগ্ন এসে গেছে সেই অঘটন ঘটনা ঘটবার।
তাই ছেলেটা বইটাকে চাকরের হাতে নিয়ে বাড়ির কারুর হাতে দিয়ে যাবার বায়না নেয়, আর সেটা দেবার পর সেই বাড়ির লোকে বলে যায়, ওঁকে বলে দেবেন সেদিন যে মেয়েটিকে পৌঁছে দিতে বলেছিলেন, তাঁকে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিলাম। আর বলবে, সামনের মাসে যদি আমাদের ম্যাগাজিনের জন্যে একটা-~
কিন্তু শেষাংশটা কে শুনেছে?
কানের পর্দায় আছড়ে পড়ছে শুধু যে মেয়েটিকে।
কে সেই মেয়ে? কেমন দেখতে?
কি রকম বয়েস?
কোথায় পৌঁছে দিয়েছিলে? একটা মাটকোঠায়?
কোথায় সেই মাটকোঠা? দেখিয়ে দেবে চল! দেখিয়ে দেবে চল।
এখন?
হ্যাঁ হ্যাঁ, এখনই তো। এখন ছাড়া আবার কখন? তোমায় আমি ছাড়ব নাকি?
ট্যাক্সিতে?
তাছাড়া আবার কী? চলো চলো, দেখে আসি চিনে আসি, সত্যি কিনা বুঝে আসি। তারপর দেখবো প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি কিনা।
রমলা বলেছিল, আমিও যাবে। কিন্তু রমলা তখন যেতে পায়নি।
যদি ঠিক না হয়? যদি রমলাকে ভেঙে গুঁড়ো হয়ে ফিরতে হয়? তার চাইতে একেবারে নিশ্চিত হয়ে প্রস্তুতি নিয়ে ভোর সকালে–
দেখা যাক সে মেয়ে আবার কেমন করে হারিয়ে যায়!
৩৭. রাজেন্দ্রলাল ইটের সেই বাড়ি
রাজেন্দ্রলাল ইটের সেই বাড়ি!
কত জন্মমৃত্যুর সাক্ষী, কত উৎসব শার উক্তনা, আলোড়ন আর আয়োজনের হিসেবক, ঝুত সুখদুঃখের নীরব দর্শক। তার এই চারখানা দেওয়ালের আড়ালে তিনপুরুষ ধরে যে জীবনযাত্রা প্রবহমাণ, তার ধারা আপাতদৃষ্টিতে হয়তো স্তিমিত নিরুচ্চার, তবু মাঝে মাঝে সেখানে ঘূর্ণি ওঠে।…হয়তো এ-বাড়ির প্রতিষ্ঠাতার সেই চিরবিদ্রোহী গৃহিণী সুবর্ণলতার আত্মার নিস্ফল বেদনা এর প্রতিটি ইটের পাজরে পাজরে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আছে বলেই সেই রুদ্ধশ্বাস বিকৃত হয়ে দেখা দেয়। তবু এদের নিত্যদিনের চেহারা বর্ণহীন বৈচিত্র্যহীন স্তিমিত। নিত্যদিন ঘড়ির একই সময়ে এদের রান্নাঘর থেকে উনুন ধরানোর চিহ্ন বহন করে ধোঁয়া ওঠে, একই সময়ে চাকর যায় বাজারে, রান্নার শব্দ, বাসন মাজার শব্দ, বাটনা বাটার শব্দ আর মহিলাদের অসন্তোষ এবং অভিযোগে মুখর করে শব্দ জানান দেয়, এরা আছে, এরা থাকবে।
হয়তো পৃথিবীতে এরাই থাকে, যাদের দিন-রাত্রিশুলো একই রকম।
শুধু এদের উৎসবের দিনগুলো অন্যরকম, মৃত্যুর দিনগুলো অন্যরকম।
সেই অন্যরকমের ছায়া নেমেছে আজ এ-বাড়ির আকাশে।
বাড়ির এদিকের ঘরে যখন বহু দুঃখ বহু যন্ত্রণা আর বহু প্রত্যাশার শেষে একটি পুনর্মিলনের নাটক অভিনীত হচ্ছে, আর এক ঘরে তখন বিচ্ছেদের মর্মান্তিক দৃশ্য।
মর্মান্তিক, বড় মর্মান্তিক!
এ-বাড়ির সেই ছটফটে ঝলমলে বেপরোয়া উদ্দাম মেয়েটা একেবারে স্থির হয়ে গিয়ে শুয়ে আছে নীল মুখ আর মুদ্রিত চোখ নিয়ে। তার ঘরের মধ্যে শরাহত বাঘের মত যে মানুষটা এ-দেয়াল থেকে ও-দেয়াল অবধি এলোমেলো পায়চারি করে বেড়াচ্ছে, তার চোখের আগুন নিভে এসেছে, বোঝা যাচ্ছে একটু পরে ঘাড় লটকে পড়বে ও।
আর ওই নিথর-হয়ে-যাওয়া মেয়েটার বিছানায় লুটোপুটি করে বিছানাটাকে আর নিজেকে বিধ্বস্ত করে যে মানুষটা কান্না চাপার ব্যর্থ চেষ্টায় বেশী করে কেঁদে উঠছে, তার আর এখন মনে পড়ছে না হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে, আমি কী কাজ করে ফেলেছি! তার এখনকার মন তীব্র আর্তনাদে বলে উঠতে চাইছে, আমার খুকু, আমার বেবি, আমার কৃষ্ণা, আমার সর্বস্বই যদি চলে গেল, তবে আর আমার মিথ্যার জাল বুনে বুনে মুখরক্ষার চেষ্টার দরকার কী দায়?