ঝি ডেকে কাজের নির্দেশ দেওয়া ব্যতীত কবে তাদের সঙ্গে বাড়তি দুটো কথা বলেছে রমলা?
অথচ এখন তার সঙ্গে অন্তরঙ্গ সখীর মতো
বিধাতা যাকে অন্য গড়ন দিতে চান, তাকে দুঃখের আগুনে পোড়ানোই যে তার কাজ।
শুধু তো ওই হৃদয়হীন মেয়েটাই নয়, আর একজনও যে তিলে তিলে ক্ষয় করছে রমলাকে অনেক দিন ধরে।
দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, ক্রমশ মাসের পর মাস কেটে যাচ্ছে–সাগরপারে চলে যাওয়া আর এক হৃদয়হীন সন্তান না আসছে ফিরে, না দিচ্ছে চিঠি। যদি বা কখনো দেয়, সে একেবারে সংক্ষিপ্তের পরের নমুনা।
মা-বাপের অনেক অভিযোগ অনুযোগ, উদ্বেগ, অকুল প্রশ্নের উত্তরে লেখে, এতো ভাবনার কী আছে? মরে গেলে কেউ না কেউ দিতই খবর। জানোই তো আমি চিঠির ব্যাপারে কুঁড়ে।
অথবা কখনো কখনো অনেকগুলো পয়সা খরচ করে একটা টেলিগ্রাম করে বসে তার কুশল সংবাদ জানাতে।
চিঠি লেখার আলসোর সপক্ষে তো কুঁড়েমির যুক্তি, আর ফিরে না আসার সপক্ষে?
পড়তে গিয়েছিলি তুই পাঁচ বছরের কোর্স, সাড়ে ন বছর হয়ে গেল আসিস না কেন, এর উত্তর?
তা সে তার জীবনের ঘটনাপঞ্জীতেই প্রকাশিত! পড়ার শেষে বছরখানেক ভ্রমণ করেছে।
ইয়োরোপ আমেরিকার মোটামুটি দ্রষ্টব্যগুলি দেখে নিতে নিতে পেয়ে গেছে চাকরি। যে চাকরিটি এখন উঠতে উঠতে আকাশ ছুঁচ্ছে। দেশে ফিরে এলে তার দশ ভাগের এক ভাগ মাইনের চাকরি জুটবে
তবে?
কোন্ সুখে ফিরে আসবে সে? কিসের আশায়? শুধু মা-বাপকে চোখের দেখা দেখতে? অত ভাবপ্রবণ হলে চলে না।
রমলার নিজেরই দাদা আর জামাইবাবু রমলাকে নস্যাৎ করে দিয়ে বলেছেন, পাগল ছাড়া আর কেউ বলবে না ছেলেকে–তুই চলে আয় তোর ওই রাজ্যপট ছেড়ে। এসে আমাদের সঙ্গে নুনভাত, ফেনভাত খেয়ে চাকরি চাকরি করে ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়া। তোর এই অস্থিরতার কোনো মানেই হয় না রমলা!
রমলা স্বামীর কাছে তীব্র হয়েছে, তুমিও একথা বলবে? কটা টাকার জন্যে খোকা চিরকাল পৃথিবীর ওপিঠে পড়ে থাকুক?
অভিযুক্ত আসামী বলে উঠতে পারেনি, না না, আমি একথা বলি না। আমারই কি খোকাকে একবার দেখবার জন্যে প্রাণ যাচ্ছে না?
যেটা বললে পিতৃহৃদয়ের পরিচয় দেওয়া যেতে পারতো।
কিন্তু কি করে দেবে সে পরিচয়।
চাকরির বাজারের হালচাল জানে না সে?
তাই সে শুকনো গলায় বলে, না বলেই বা উপায় কি? ওকে আমি মাথার দিব্যি দিয়ে ফিরিয়ে এনে ওর উপযুক্ত কোনো কাজ জুটিয়ে দিতে পারবো? সেখানে রাজার হালে রয়েছে–
শুধু রাজার হালে থাকাটাই সব? মা বাপ, নিজের দেশ, সমাজ, এসব কিছুই নয়?
সেটা তার বিবেচ্য। মানু হতাশ গলায় বলেছে, মানুষ মাত্রেই ত এটাই জানে রাজার হালে থাকাটাই সব।
আমি এবার ওকে দিব্যি দিয়ে চিঠি দেব। রমলা উত্তেজিত গলায় ঘোষণা করেছিল এবং দিয়েও ছিল সে চিঠি।
ঈশ্বর জানেন কী দিব্যি দিয়েছিল সে। কিন্তু সে চিঠির আর উত্তরই এলো না। প্রত্যাশার দিনগুলি ঝাপসা হতে হতে ক্রমশই মিলিয়ে যাচ্ছে।
এরপর যদি রমলা সরাসরি দেবীর মুখ থেকে তপন বিদীর্ণ হৃদয়ের প্রশ্নের উত্তর পাবার শাস পায়, তাহলে ছুটে যাবে না সেখানে? সে আশ্বাসটা কার কাছ থেকে পাচ্ছে তা কি বিবেচনা করে দেখতে বসবে? ওই বাসনমাজা ঝিটাকেই তখন তার কাছে দেবীর অংশ বলে মনে হয়েছে।
অথচ মাত্র কিছুদিন আগেও কি রমলা স্বপ্নেও ভাবতে পারতো সে এমন একটা গ্রাম্য কাজ করতে পারবে?
অলকার গুরুভক্তির বহর দেখে সে মনে মনে হেসেছে।
রমলার শাশুড়ী যখন বেঁচেছিলেন, তখন রমলা বরের বদলির চাকুরিসূত্রে বাইরে বাইরে ঘুরছে, জানে না শাশুড়ী কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিলেন কি সংস্কারমুক্ত ছিলেন। কিন্তু কলকাতায় হেড় অফিসে বদলি হয়ে স্থায়ীভাবে কলকাতায় থাকা অবধি বড় জাকে দেখছে। দেখেছে তার নাতি-নিয়ম।
কারো অসুখ করলে বড়গিন্নী ডাক্তারের ওষুধের থেকে অনেক বেশী আস্থা রাখেন মাকালীর খাড়া ধোওয়া জল অথবা মসজিদের জলপড়ার উপর।
রমলা মনে মনে ওই বড় জাকে মুখ্য গাঁইয়া ছাড়া আর কিছু ভাবেনি কখনো।
কিন্তু তখন তো রমলা টাটকা।
তখন রমলার ছেলে টকটক করে ফার্স্ট হয়ে হয়ে ক্লাসে উঠছে, তখন রমলার ছবির মত মেয়েটা নেচে-গেয়ে সারাদিন অনর্গল ছড়া আবৃত্তি করে বাড়ি মাত করে রাখছে। তখন রমলা কেমন করে জানবে সন্তানের মাকে ভূত ভগবান সবই মানতে হয়, মানতে হতে পারে।
.
রুদ্ধদ্বার কক্ষে ‘দেবী’ রমলার কোন্ এগের কী উত্তর দিলেন, তা রমলাই জানে আর দেবীই জানেন, তবে বাড়ি ফিরলো রমলা যেন কী এক আশা-প্রত্যাশায় ছল-ছল করতে করতে।
ঘরে ঢুকে দেখলো স্বামী চুপচাপ বিছানায় বসে। থমকে বললো, এভাবে বসে যে?
মানু সে কথার উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন করলো, একা একা কোথায় গিয়েছিলে?
একা নয়। সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল ছোটবৌ।
তারপর হঠাৎ নিজে থেকেই বলে উঠলো, গিয়েছিলাম এক জায়গায়, পরে বলবো।
খোকার একটা চিঠি এসেছে বিকেলে, তোমায় খুঁজছিলাম—
খোকার চিঠি এসেছে!
রমলা বিহ্বলভাবে তাকিয়ে বলে, খোকার? খোকার চিঠি এসেছে? সত্যি এসেছে? ওগো তাহলে তো জগতে অবিশ্বাসের কিছু নেই। এইমাত্র জেনে এলাম শীগগির খবর আসবে। আর আজই-কই, কোথায় চিঠি, দাও? কাকে লিখেছে? রমলার কণ্ঠে ব্যস্ততা।
মানু আস্তে বালিশের তলা থেকে চিঠিটা বার করে দিয়ে বলে, তোমার চিঠি, আমি কিন্তু খুলে দেখেছি, ধৈর্য ধরা শক্ত হচ্ছিল