সম্মেলনে আগত কয়েকজন কিন্তু ব্যাপারটাকে পাড়ার কতকগুলো বদ ছেলের অসভ্যতা বলে উড়িয়ে দিতে রাজী হলেন না, তারা এর থেকে শৌলমারীর গন্ধ পেলেন, নকশালবাড়ির পদধ্বনি আবিষ্কার করলেন। অর্থাৎ ব্যাপারটাকে জুড়িয়ে দিতে রাজী হলেন না তারা।
সেক্রেটারীর বড় বাড়ি, দালান বড়।
অনেকেই ঢিল থেকে আত্মরক্ষা করতে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ আলোচনার ধারা অন্য খাতে বাওয়ালেন।
গলার স্বর নামিয়ে বলাবলি করতে লাগলেন তারা, প্রধান অতিথি অবিমৃষ্যকারিতা করেছেন, এরকম সভায় ফট করে আধুনিক সাহিত্যে শ্লীলতা-অশ্লীলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা ঠিক হয়নি ওর। মৌচাকে ঢিল দিতে গেলে তো ঢিল খেতেই হবে, সাপের ল্যাজে পা দিলে ছোবল।…
আরে বাবা বুঝলাম তুমি একজন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক, বাজারে তোমার চাহিদা আছে, যথেষ্ট নামডাক আছে, মানে মানে সেইটুকু নিয়ে টিকে থাকো না বাবা! তা নয়—তুমি হাত বাড়িয়ে হাতী ধরতে গেলে! যুগকে চেনো না তুমি? জানো না এ যুগ কাউকে অমর হতে দিতে রাজী নয়, সবকিছু ঝেঁটিয়ে সাফ করে নিজের আসন পাতবার সংকল্প নিয়ে তার অভিযান?
অনামিকা দেবী ঘরের ভিতরে বসেছিলেন ভি আই পি-দের সঙ্গে, তিনি বাইরের ওই কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিলেন না। তিনি শুধু ওই রাজনীতিই শুনছিলেন আর ভাবছিলেন, আগুন ধূমায়িত হয়েই আছে, যে কোনো মুহূর্তে জ্বলে ওঠবার জন্যেই তার প্রস্তুতি চলছে, শুধু একটি দেশলাই-কাঠির ওয়াস্তা।
হয়তো ওই প্ৰস্তুতিটা ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু আগুন যখন জ্বলে ওঠে তখন সব আগুনের চেহারাই এক।
সেই ভাঙচুর, তছনছ।
কার জিনিস কে ভাঙছে, কে কাকে ক্ষতিগ্রন্ত করছে, হিসেবও নেই তার।
হঠাৎ এই সময় ওই খবরটা এসে পৌঁছলো। মাইকের ডাণ্ডা ঠুকে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির নাকের হাড় ভেঙে গেছে।
০৭. খবরটা শুনে স্তব্ধ
খবরটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন অনামিকা দেবী।
সেই সদাহাস্যমুখ প্রিয়দর্শন ভদ্রলোকটি।
তার বাড়িতেই অনামিকা দেবী রয়েছেন। আর একদিনেই যেন একটি আত্মীয়তা-ভাব এসে গেছে।
ভদ্রলোকের নাম অনিল, তার মা কিন্তু তাকে ডাকছিলেন নেনু নেনু বলে। ভদ্রলোক হেসে বলেছিলেন, নাঃ, তুমি মানসম্মান কিছু রাখতে দেবে না মা! দেখুন-এতো বড় ছেলেকে আপনার মতো একজন লেখিকার সামনে, এই রকম একটা নামে ডাকা!
সুন্দর ঘরোয়া পরিবেশ।
এটা প্রীতিকর।
অন্ততঃ অনামিকা দেবীর কাছে। অনেক সময় অনেক বাড়িতে দেখেছেন অদ্ভুত আড়ষ্ট একটা কৃত্রিমতা। অনামিকা দেবী যে একজন লেখিকা, এটা যেন তারা অহরহ মনে জাগরূক না রেখে পারছেন না। বড় অস্বস্তিকর।
অনামিকা দেবী তখন অনিলবাবুর কথায় হেসে বলেছিলেন, ওতে অবাক হচ্ছি না আমি। আমারও একটি ডাকনাম আছে, যা শুনলে মোটেই একটি লেখিকা মনে হবে না।
ভদ্রলোক বলেছিলেন, অধিবেশন হয়ে যাক, আপনার লেখার গল্প শুনবো।
লেখার আবার গল্প কি? হেসেছিলেন অনামিকা দেবী।
অনিলবাবু বলেছিলেন, বাঃ গল্প নেই? আচ্ছা গল্প না হোক ইতিহাসই! কবে থেকে লিখছেন, প্ৰথম কী ভাবে লেখার প্রেরণা এলো, কী করে প্রথম লেখা ছাপা হলো, এই সব!
অনামিকা দেবী বলেছিলেন, বাল্মীকির গল্প জানেন তো? মরা মরা বলতে বলতে রাম। আমার প্রায় তাই। লেখা শব্দটা তখন উল্টো সাজানো ছিল। ছিল খেলা। সেই খেলা করতে করতেই দেখি কখন অক্ষর দুটো জায়গা বদল করে নিয়েছে। কাজেই কেন লিখতে ইচ্ছে হলো, কার প্রেরণা পেলাম এসব বলতে পারবো না।
অনিলবাবুর স্ত্রী বলেছিলেন, আচ্ছা ওঁকে নাইতে খেতে দেবে না? যাও এখন পালাও। গল্প পরে হবে।
সেই পর টা আর পাওয়া গেল না।
সমন্ত পরিবেশটাই ধবংস হয়ে গেছে।
হঠাৎ ভয়ানক একটা কুণ্ঠা আসে অনামিকা দেবীর, নিজেকেই যেন অপরাধী অপরাধী লাগছে।
এই অনিলবাবুর বাড়িতেই তো তার থাকা। এই বিপদের সময় অনিলবাবুর মা আর স্ত্রী হয়তো অনামিকা দেবীর অসুবিধে নিয়ে, আহার আয়োজন নিয়ে ব্যন্ত হবেন। হয়তো অনামিকা দেবীকে
না, ওঁরা যদিও বা না ভাবেন, নিজেই নিজেকে অপয়া ভাবছেন অনামিকা দেবী।
ভাববার হেতু না থাকলেও ভাবছেন।
আর ভেবে কুণ্ঠার অবধি থাকছে না। এখনই অনামিকা দেবীকে ওঁদের বাড়িতে গিয়ে ঢুকতে হবে, খেতে হবে, শুতে হবে।
ইস! তার থেকে যদি তাকেও সেই স্কুলবাড়ির কোনো একটা ঘর দিতো!
কিন্তু তা দেবে না।
মহিলাকে মহিলার মত সসম্ভ্রমেই রাখবে। তাই স্বয়ং মূল মালিকের বাড়িতেই।
অথচ অনামিকা দেবীর মনে হচ্ছে, আমি কী করে অনিলবাবুর মার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো?
হঠাৎ কানে এলো কে যেন বলছে, নাকের হাড়! আরে দূর! ও এমন কিছু মারাত্মক নয়।
শুনে খারাপ লাগলো।
মারাত্মক নয় বলেই কি কিছুই নয়?
যে আঘাতে উৎসবের সুর যায় থেমে, নৃত্যের তাল যায় ভেঙে, বীণার তার যায় ছিঁড়ে— সেটাও দুঃখের বৈকি।
কতো সময় ওই তুচ্ছ আঘাতে কতো মুহূর্ত যায় ব্যর্থ হয়ে!
.
মারাত্মক নয়, কিন্তু বেদনাদায়ক নিশ্চয়ই।
বাড়িটা যেন থমথম করছে।
যেন শোকের ছায়া কোথায় লুকিয়ে আছে। অপ্রত্যাশিত এই আঘাত যে সেই উৎসাহী মানুষটার মনের কতখানি ক্ষতি করবে। তাই ভেবে শঙ্কিত হচ্ছেন জননী-জায়া।
হাসপাতাল থেকে রাত্রে ছাড়েনি, কাল কেমন থাকেন দেখে ছাড়বে। মন-ভাঙা মা আর স্ত্রী অনামিকা দেবীর সঙ্গে সামান্য দু-একটি কথা বলেন, তারপর সেই বৌটির হাতে ওকে সমর্পণ করে দেন। যে বৌটি কলকাতার মেয়ে, যে অনামিকা দেবীর পায়ে পায়ে ঘুরছে আজ সারাদিন।