আরে বাবা, না না। একজন মহিলা আর একজন তার বডিগার্ড। আর না-হয়তো একজন—
হঠাৎ চুপ করে যায় বংশী।
খুব তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, এই দেখ, এঁরা চলেই এসেছেন।…যা সিঁড়ি, আপনারা উঠতে পারলেন?
পুরুষটি কাঁপা-কাঁপা গলায় বলে ওঠেন, পারতেই হবে। না পারলে চলবে কেন? তারপর প্রায় কাঁপতে কাঁপতেই চৌকিতে বসে পড়েন।
তার পরের ঘটনাটা অতি সংক্ষিপ্ত, অতি সরল।
এবং তার পরের দৃশ্য আগেই বলা হয়েছে।
এখন এই অসুবিধে চলছে, শম্পা কিছুতেই মুখ তুলছে না। সেই যে বাবার কোলে মুখ গুঁজে পড়েছিল তো সেই পড়েই আছে।
বংশী বার বার বলেছে, শম্পা ওঠো। বাবাকে-মাকে প্রণাম করো। মার দিকে তাকাও।
শম্পা সে-সব শুনতে পেয়েছে বলে বোঝা যাচ্ছে না।
বংশী শম্পাকে ‘তুই’ করেই কথা বলে, এখন এঁদের সামনে এঁদের মেয়েকে তুই করতে যেন সমীহ আসছে বংশীর, নিজেকে ভারী ক্ষুদ্র তুচ্ছ মনে হচ্ছে তার।
যেন এবার অনুভব করতে পারছে বংশী, সে এবার অবান্তর হয়ে যাবে শম্পা নামের মেয়েটার জীবন থেকে, অবান্তর হয়ে যাবে তার বন্ধুর জীবন থেকেও।
এতদিন পরে এঁরা এসেছেন বাধা অতিক্রমের প্রস্তুতি নিয়ে, শম্পাকে পরাজিত করবার সংকল্প নিয়ে। এঁরা হেরে ফিরে যাবেন না।
তারপর?
তারপর বংশী থাকবে, আর থাকবে তার এই মাটকোঠার বাসার অন্ধকার, অন্ধকার ঘরখানা আর এই নড়বড়ে বারান্দাটা।
কিন্তু তখন কি কোনোদিনই আর এখানে সকালের রোদ এসে পড়বে? বিকেলের বাতাসটুকু হবে?
শম্পা বলেছিল, বংশীদা, আমার সঙ্গে চলো। আমি কেমন সাহস পাচ্ছি না।
বংশী হেসে উঠেছিল, তোর বাপের বাড়িতে তুই যাচ্ছিস, আমি যাবো ভরসা দিতে?
শম্পার মা-বাবাও অনুরোধ করেছিলেন বৈকি। বলেছিলেন, এতটুকু দেখেই বুঝতে পারছি তুমিই ওদের সহায়, তোমাকেও যেতে হবে।
কিন্তু বংশী কি করে যাবে?
তার যে ঠিক এই সময়ই ভীষণ কাজ রয়েছে।
ওঁরা মেয়ে-জামাইকে নিয়ে যাবার জন্যে তোড়জোড় করছেন, জামাইয়ের কোনো ওজর আপত্তিই কানে নিচ্ছেন না, মেয়ের তো নয়ই। বলছেন, বার বার ভূল করেছি, আর ভুল করতে রাজী নই।
এর মাঝখান থেকে বংশী তার ভীষণ দরকারী কাজের জন্যে চলে গেল। শম্পা বললো, আর কোনোদিন দেখা করবে না বংশীদা?
বংশী হেসে উঠে বললো, এই দেখ, এরপর কি আর বংশীদাকে মনেই থাকবে তোর?
শম্পা শান্ত গলায় বলল আমাকে তোমার এমনিই অকৃতজ্ঞ মনে হয় বংশীদা?
বংশী বললো, না না, ও আমি এমনি বললাম। জানিসই তো, আমি ওসব উঁচুতলার লোকদের দেখলে ভয় পাই।
তোমার বন্ধুও পায়।
ওকে তো তুই মানিয়ে নিবি।
বলে পালিয়ে গিয়েছিল বংশী।
.
হ্যাঁ, মানিয়ে নেবার ক্ষমতা শম্পার আছে।
তাই বলে মা-বাবার পাগলামির হাওয়ায় গা ভাসাতে পারে না।
মা বলেছিল, লোকজন নেমন্তন্ন করে ঠিকমত বিয়ের অনুষ্ঠান করি—
শম্পা জোরে হেসে উঠে বলে দিলো, দোহাই তোমার মা, আর লোক হাসিও না।
এ রকম তো আজকাল কতই হচ্ছে, মার গলাটা ক্ষীণ শোনালেও শোনা গিয়েছিল, আমাদেরই আত্মীয়-কুটুম্বর বাড়িতে হচ্ছে। কতদিন আগে রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে, আবার নতুন করে গায়েহলুদ-টলুদ সব করে ভাল করে বিয়ে হচ্ছে।
তাদের অনেক সাধ মা, আমার আর বেশী ভালয় সাধ নেই।
শম্পার বাবা নিশ্চিন্ত ছিলেন ওরা এখানেই থাকবে, তাই নিজেদের ঘরটাকে ঝালাইটালাই করছিলেন মেয়ে-জামাইয়ের জন্যে।
নিজেদের?
পাশের ওই ছোট ঘরখানাই যথেষ্ট।
কিন্তু শম্পা সে প্রস্তাব হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। বলেছে, বাবা গো, একেই তো ওই এক অপদার্থর গলায় মালা দিয়ে বসে আছি, তার ওপর যদি আবার ঘরজামাই বনে যায়, তাহলে তো আমার মরা ছাড়া আর গতি থাকবে না! ঘরজামাই আর পুষ্যিপুতুর এরাই তো শুনেছি জগতের ওঁচা!
শম্পা হেসে উঠেছিল, না বাবা, ওটা আর করছি না, ওতে তোমাদের প্রেস্টিজটা বড়ো পাংচার হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। তবে দেখেশুনে একটা কোঠা ঘরে গিয়েই উঠতে হবে। সেই জন্যেই তো বলছি একটা ভাল চাকরি আমার বিশেষ দরকার। দাও না বাবা একটা মোটা মাইনের চাকরিবাকরি করে। কত তো কেষ্টবিষ্টর সঙ্গে চেনা তোমার।
চেনা দিয়ে কোনো কাজ হয়, এই তোর ধারণা?
হয় না বলছো? তবে নিজেই উঠে-পড়ে লাগি বাবা? দেখ তখন কী একখানা ছবির মতন সংসার বানাবো।
শম্পার চোখে আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি।
.
শম্পার মুখে দৃঢ়তার ছাপ।
কিন্তু এমন অঘটনটা ঘটলো কোন্ যোগসূত্রে? শম্পার মা-বাপ তার মাটকোঠায় ঠেলে গিয়ে উঠলো কি করে?
সে এক অভাবিত যোগাযোগ।
অথবা বিধাতার ভাবিত। আপন কাজ করিয়ে নেবার তালে অনেক কৌশল করেন তিনি। আর তার জন্যেও থাকে অন্য আয়োজন।
সেই আয়োজনের চেহারাটা এই
শম্পার মা রমলা বিকেলবেলা কোথায় যেন কোন মন্দিরে গিয়েছিল। সেখানে নাকি ভরসন্ধ্যেবেলা কোন্ কালীসাধিকার উপর দেবীর ভর হয়, তিনি সেই ভরের মুখে আর্তজনের সর্বপ্রকার আকুল প্রশ্নের উত্তর দেন। রোগ-ব্যাধি থেকে শুরু করে হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ, মেয়ের বিয়ে, ছেলের চাকরি, মামলার ফলাফল, সবই তার এলাকাভুক্ত।
রমলা গিয়েছিল তার আকুল প্রশ্ন নিয়ে।
এই অলৌকিকের সংবাদদাত্রী হচ্ছে বাড়ির বাসনমাজা ঝি। রমলা কাউকে কিছু না জানিয়ে চুপিচুপি তার সঙ্গে চলে গিয়েছিল।
চিরদিনের আত্মসমবোধ-সচেতন, মর্যাদাবোধ-প্রখর, স্বল্পবাক রমলার এমন অধঃপতন অবিশ্বাস্য বৈকি। ঝিয়ের সঙ্গে এক রিকশায় বেড়াতে বেরুনো ভাবা যায় না। তা ছাড়া এতো সাহস ওই ঝি-টা পেলো কখন যে, রমলার কাছে এই অলৌকিক কাহিনী ফেঁদে বসে তাকে নোওয়াতে পারলো?