‘বিয়ে পৈতে ভাত’–এর যোগ্য কে আছে?…অলকার মেয়ের বিয়েটিয়ে নয় তো? হয়তো বকুলকে বলবার প্রয়োজন বোধ করেনি।
আহা তাই যেন হয়।
তা না হলে ওই মেয়েটাও হয়তো একটা ঘোরালো গল্পের প্লট হয়ে উঠবে।
বকুল কি ওই শখের শব্দে নেমে যাবে? হেসে হেসে বলবে, কি গো, আমায় বাদ দিয়েই জামাই আনছো?
স্বাভাবিক হবে সেটা?
নাকি সাজানো-সাজানো দেখাবে?
যাই হোক, বকুল নেমেই এল, আর নেমে এসেই স্তব্ধ হয়ে গেল।
সে স্তব্ধতা তখনো ভাঙল না, যখন একখানা ঝড়ের মেঘ এসে গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
পিসি!
বকুল অবাক হয়ে দেখতে থাকে, বড় দালানে বাড়ির সবাই এসে দাঁড়িয়েছে, অপূর্ব অলকা বাদে…রয়েছেন বড় বৌদি, বড় বৌদির বৌ আর মেয়েরা। রুগ্ন সেজ বৌদিও। নানা বয়সের কতকগুলো ছেলেমেয়ে।
তাছাড়া অনেকগুলো ঝি-টি।
বাড়িতে এতো ঝি আছে তা জানতো না বকুল।
জানতো না এতো ছেলেময়ে আছে।
হঠাৎ মনে পড়ল বকুলের, আমি কী-ই বা জানি? কতটুকুই বা জানার চেষ্টা করি?
শম্পার চোখে জল, শম্পার মা-বাবার চোখে জল। এমন কি দালানের মাঝখানে যাকে একটা হাতল দেওয়া ভারী চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে, সেই সত্যবানের চোখেও যেন জল।
শুধু বকুলের চোখটা যে শুকনো-শুকনোই রয়েছে সেটা বকুল নিজেই অনুভব করছে।
বকুলের হঠাৎ নিজেকে কেমন অসম্ভব মনে হচ্ছে। যেন এখানে বকুলের কোনো ভূমিকা নেই।…
অথচ থাকতে পারতো। বকুল সে সুযোগ নেয়নি।
ইচ্ছে করেই তো নেয়নি, তবু বকুলের মুখটা দারুণ অপ্রতিভ–অপ্রতিভ লাগছে।
দেখে মনে হচ্ছে, আজকের এই নাট্যদৃশ্যের নায়িকা স্বয়ং বকুলের ছোট বৌদি। এই তো ঠিক হলো, এটাই তো চেয়েছিল বকুল। তবু বকুল ভয়ঙ্কর একটা শূন্যতা অনুভব করছে। যেন বকুলের একটা বড় জিনিস পাবার ছিল, বকুল সেটা অবহেলায় হারিয়েছে।
বকুল বোকা বনে গেছে।
বকুল অবাক হয়ে দর্শকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে দেখছে, ছোট বৌদি তার সদ্যলব্ধ জামাইয়ের সামনে জলখাবারের থালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।….
দেখছে,. ছোড়দা অনুরোধ করছেন, আহা বেশী আবার কি? ওটুকু খেয়ে নাও! ভাত খেতে বেলা হবে।
এর আগে নাটকের যে দৃশ্যটা অভিনীত হয়ে গেছে সেটা বকুলের অজানা, তাই বকুল বোকা বনে যাচ্ছে।
মস্ত একটা পাহাড় দাঁড়িয়ে ছিল সমস্ত পথটা জুড়ে, সমস্ত শুভকে রোধ করে। ওই অনড় অচলকে অতিক্রম করা যাবে, এ বিশ্বাস ছিল না কারুর।
দুর্লঙ্ঘ্য বাধা! কারণ বাধাটা মনের।
মনের বাধা ভাগ্যের সমস্ত প্রতিকূলতার থেকে প্রবল। মানুষ সব থেকে নিরুপায় আপন মনের কাছে। সে জগতের অন্য সমস্ত কিছুর উপর শক্তিশালী প্রভু হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু নিজের মনের কাছে শক্তিহীন দাসমাত্র।
তাই অভিমানের পাহাড় হিমাচল হয়ে উঠে জীবনের সব কল্যাণকে গ্রাস করে বসে।
এতদিন ধরে সেই পাহাড়টা নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে অলঙ্ঘ্যের ভূমিকা নিয়ে। কেউ একবার ধাক্কা দিয়ে দেখতে চেষ্টা করেনি, দেখি অতিক্রম করা যায় কিনা। না পাহাড়ের ওপারের লোক, না বা এপারের।
অথচ ভিতরে ভিতরে ভাঙন ধরেছে, অনমনীয়তার খোলস খুলে পড়েছে। তবু দূরত্বের ব্যবধান দূর হচ্ছে না।
.
আবার মন অনন্ত রহস্যময়ী।
কখন এক মুহূর্তে তার পরিবর্তন ঘটে। যাকে ভাবা হয়েছে দুর্লঙ্ঘ্য পাথরের পাহাড়, সহসাই তা মেঘের পাহাড়ের মত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তখন অভিমান হয়ে ওঠে আবেগ। যা কিছুতেই পারা যাবে না বলে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকা হয়েছে, তখন তাকত অনায়াসেই পার হয়ে যায়।
তা নইলে শম্পাকে কেমন করে তার বাবার কোলে মুখ রেখে বসে থাকতে দেখা যায়, আর তার বাবাকে বসে থাকতে দেখা যায় শম্পার সেই মাটকোঠার বাড়ির নড়বড়ে বারান্দায়, ততোধিক নড়বড়ে চৌকিটার ওপর।
শম্পার মাকেও দেখা যায় বৈকি। দেখা যায় আরো আশ্চর্য পরিস্থিতিতে তিনি তাঁর জামাইয়ের পিঠে হাত রেখে বসে আছেন, সে হাতে স্নেহস্পর্শ।
অথচ মুহূর্তেই ঘটে গেছে এই অঘটন। এ অঙ্কে বকুল নেই।
তখন সকালের রোদ এই বারান্দাটায় এসে পড়েছিল। নতুন শীতের আমেজে সেই রোদটুকু লোভনীয় মনে হয়েছিল, তাই শম্পা সত্যবানকে টেনে নিয়ে এসে বসিয়ে চায়ের তোড়জোড় করছিল।
তখন শম্পা নিত্যদিনের মতই টোস্টে মাখন লাগাচ্ছে, আর সত্যবান নিত্যদিনের মতই অনুযোগ করছে–একজনের রুটিতে অত পুরু করে মাখন মাখানো মানেই তো অন্যজনের রুটিতে মাখন না জোটা!
ঠিক সেই সময় বংশী এসে বলল, এই শম্পা, তোকে কারা যেন খুঁজতে এসেছে।
কা-রা।
শম্পার হাত থেকে মাখনের ছুরিটা পড়তে পড়তে রয়ে গেল।
আমাকে আবার কারা খুঁজতে আসবে বংশীদা? পিসি কি? সঙ্গে কে?
তা কি করে জানব? তোর প্রাণের পিসিকে দেখার সৌভাগ্য তো হয়নি কোনোদিন। তা তুই তো বলিস পিসি চিরকুমারী, তাই না? ইনি তো বেশ সিঁদুর-টিদর পরা! যাক, কে কী বৃত্তান্ত সেটা এখানে বসে চিন্তা না করে নেমে চল্ চটপট!
বংশীদা, আমার কী রকম ভয়-ভয় করছে! তুমি বরং জিজ্ঞেস করে এসো কে ওঁরা? সত্যিই আমায় খুঁজতে এসেছেন কিনা?
আমি আর পারবো না। কারণ ওসব কথা হয়ে গেছে। চল বাবা চটপট! তোর “ভয়”। এ যে রামের মুখে ভূতের নাম!
সত্যবান আস্তে বলে, দেখেই এসো না শম্পা।
শম্পা চৌকিটায় বসে পড়ে শুকনো গলায় বলে, দুজন কে কে বংশীদা? দু-জনই মহিলা?