কিন্তু বরের হাতের লেখায়, পাতায় পাতায় পাড়ার একটা মেয়ের নাম লেখা খাতাখানা তো চিরদিন সহ্য করেও এসেছে মাধুরী! চিরদিন তো মাধুরী সব-ফুরিয়ে-যাওয়া বুড়ী হয়ে যায়নি?
কিন্তু বকুল তো এ খাতাখানা কিছুতেই ধৈর্য ধরে আগাগোড়া পড়ে উঠতে পারছে না। বকুল কেবলই পাতা ওলটাচ্ছে। বকুলের মনই বসছে না।
বকুলের মাঝে মাঝে কাঁচা ভাষায় উচ্ছ্বসিত ভাবপ্রবণতা দেখে হাসিও পেয়ে যাচ্ছে।
বকুল-বকুল! তুমি আমার জীবনের স্থির লক্ষ্য। তুমি আমার ধ্রুবতারা!…আমার সব কিছুর মধ্যে তুমি।…বকুল…যখন একা থাকি..চুপিচুপি তোমার নাম উচ্চারণ করি…।
বকুল পৃষ্ঠার কোণে লেখা সাল তারিখটা দেখল।
বকুল একটু হেসে খাতাখানা বন্ধ করল।
বকুল ভাবল, রেখা-বৌমা ঠিকই বলেছে–যে বস্তু এক সময় পরম মূল্যবান থাকে, আর এক সময় তা নিতান্তই মূল্যহীন হয়ে যায়, প্রতিক্ষণেই মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটছে।
৩৬. বোম্বাইতে বাঙালী চিত্রাভিনেত্রী
বোম্বাইতে বাঙালী চিত্রাভিনেত্রীর শোচনীয় জীবনাবসান।
খবর বটে, তবে দৈনিক খবরের কাগজের নয়। একটা বাজেমার্কা সাপ্তাহিকে ফলাও করে ছেপেই খবরটা। কারণ এ পত্রিকার মূল উপজীব্যই সিনেমা-ঘটিত রসালো সংবাদ।…এরা চিত্রজগতের তুচ্ছ থেকে উচ্চ পর্যন্ত সব খবর সংগ্রহ করে ফেলে নিজেদের রুচি অনুযায়ী ভাষায় এবং ভঙ্গিমায় পরিবেশন করে কাগজের কাটতি বাড়ায়। অতএব এদের কাছে নামকরা আর্টিস্টদের প্রণয় এবং প্রণয়ভঙ্গের খবরও যেমন আহ্লাদের যোগানদার, আত্মহত্যার খবরও তাই।
দুটো তিনটে সংখ্যা এখন ওই নিয়ে ভরানো যাবে। খড়-বাঁশের কাঠামোর উপর মাটির প্রলেপই শুধু নয়, রং-পালিশও এদের আয়ত্তে। তা এদেরও একরকম শিল্পী বলা যায়।
এ পত্রিকা প্যাকেট খুলে পড়বার কথা নয়, নেহাৎই এই কটায় কোনো চিঠিপত্র আসেনি বলেই অনামিকা দেবীর নামে সযত্নে প্রেরিত এই হতচ্ছাড়া পত্রিকাখানার মোড়ক খুলে পাতা উল্টে চোখ বুলোচ্ছিল বকুল, হঠাৎ একটা পৃষ্ঠায় চোখ আটকে গেল।
এ ছবিটা কার?
মদির হাস্যময় এই মুখের ছবি কি আগে কোথাও দেখেছে বকুল? কিন্তু তখন এমন মদির হাস্যের ছাপ ছিল না!
হ্যাঁ, এ মুখ বকুলের দেখা, কিন্তু আর দেখবে না কখনো। দেখা হবে না কোনদিন। বার বার পড়লো বকুল ওই ছবির নীচের ছাপানো সংবাদটা, কিন্তু যেন বোধগম্য হচ্ছে। ছায়া-ছায়া লাগছে।
বোম্বাইতে বাঙালী চিত্রাভিনেত্রীর শোচনীয় জীবনাবসান।…বম্বের বিখ্যাত নবাগতা চিত্রাভিনেত্রী লাস্যময়ী যৌবনবতী শ্রীমতী রূপছন্দা গত সোমবার তার নিজস্ব ফ্ল্যাটে– অতিরিক্ত মাত্রায় ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
এই আত্মহত্যার কারণ অজ্ঞাত।
শ্ৰীমতী রূপছন্দা তার ফ্ল্যাটে একাই বাস করলেও বহুজনের আনাগোনা ছিল। শ্ৰীমতী রূপছন্দার বেপরোয়া উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্ৰাপদ্ধতি পরিচিত সমাজকে ক্রমশই বিরূপ করে তুলেছিল, রূপছন্দা তার ধার ধারতেন না।
তবে সম্প্রতি কেউ কেউ তার জীবনের একটি রহস্যময় ঘটনার কথা উল্লেখ করছেন। আত্মহত্যার দু’দিন পূর্বে নাকি তিনি জুহুর উপকূলে এক নির্জন প্রান্তে গভীর রাত্রি পর্যন্ত একা বসেছিলেন এবং সেখানে নাকি একবার এক গেরুয়াধারী সাধুকে দেখা গিয়েছিল।
ওই সাধুর সঙ্গে এই মৃত্যুর কোনো যোগ আছে কিনা সে রহস্য অজ্ঞাত, পুলিস সেই সাধুকে অনুসন্ধান করছে।…
শ্রীমতী রূপছন্দার নৈতিক চরিত্র যাই হোক, ব্যক্তিগতভাবে তিনি নানা সদগুণের অধিকারিণী ছিলেন, দুঃস্থ অভাবগ্রস্তদের প্রতি ছিল তার প্রবল সহানুভূতি। তার এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেকে তাকে প্রতারণাও করেছে, কিন্তু শ্রীমতী রূপছন্দার দানের হাত অকুণ্ঠই থেকেছে।…পরবর্তী সংখ্যায় ‘রূপছন্দার মৃত্যুরহস্য’ বিশদভাবে জানানো হবে।
জীবনের প্রারম্ভ দেখে কে বলতে পারে সেই জীবন কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, কী ভাবে শেষ হবে!
জলপাইগুড়ির সেই নম্র নতমুখী বধূ নমিতা, বম্বের এক বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে, ডানলোপিলোর গদিতে শুয়ে ঘুমের বড়ি খেয়ে চিরদিনের মত ঘুমিয়ে গেল।….
কিন্তু নমিতা যা যা চেয়েছিল সবই তো আহরণ করতে পেরেছিল। অর্থ, প্রতিষ্ঠা, নাম, খ্যাতি, স্বাধীনতা। চেয়েছিল তার পুরনো পরিচিত জগৎকে দেখিয়ে দিতে, সে তুচ্ছ নয়, মূল্যহীন নয়। তবু নমিতা ওই ঘুমের বড়িগুলো আহরণ করতে গেল কেন?
আবছা ভাবে সেই নতমুখী মেয়েটাকেই মনে পড়ছে যে বলেছিল, আমায় নিয়ে গল্প লিখবেন? আমি আপনাকে প্লট দিতে পারি!
অনামিকা দেবী সেই আবেদন হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন বলেই কি নমিতা আরো ঘোরালো প্লটের যোগান দিতে বসেছিল?
কিন্তু এই ঘোরালো প্লটটাকে নিয়েই কি লিখতে বসবেন অনামিকা দেবী?
কি লিখবেন?
আজকের সমাজে কি আর এ প্লট নতুন আছে? কোনটা থাকছে নতুন? নতুন হয়ে আসছে, মুহূর্তে পুরনো হয়ে যাবে। এ তো সর্বদাই ঘটছে।
তবু বকুল যেন একটা অপরাধের ভার অনুভব করছিল। কিন্তু নিয়তিকে কি কেউ ঠেকাতে পারে?
অনেকক্ষণ বসেছিল, হঠাৎ নিচের তলায় খুব জোরে জোরে ভোঁ ভোঁ করে শাঁখ বেজে উঠল।
এমন দুপুর রোদে হঠাৎ শাখের শব্দ কেন? বাড়িতে কি কোনো মঙ্গল অনুষ্ঠানের ব্যাপার ছিল? অন্যমনস্ক বকুল সে খবর কান দিয়ে শোনেনি, অথবা শুনে ভুলে গেছে?
কিন্তু কারই বা কি হতে পারে?