বকুল আস্তে মাথা নেড়ে বলে, না, সে আর কোনোদিনই লেখা হয়নি মাধুরী-বৌ। লিখবো ভাবলে মনে হতো, লেখবার মত আছে কী? এ তো জগতের নিত্য ঘটনার একটা টুকরো। কোথায় বা বিশেষত্ব, কোথায় বা মৌলিকত্ব, তারপর হঠাৎ
বকুল একটু চুপ করে থেকে বলে, তখন মনে হল, আর লিখেই বা কী হবে?…আসল কথা, নিজের কথা লেখা বড় শক্ত। তাদের কাছেই ওটা সহজ, যারা নিজের কথার ওপর অনেক রংপালিশ চাপিয়ে জৌলুস বাড়াতে পারে, যাতে জিনিসটা মূল্যবান বলে মনে হয়। সেটা তো সবাই পারে না।
মাধুরী একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, ওইটা নিয়ে ওর একটু অভিমান ছিল।
বকুল মাধুরীর হাতটায় একটু চাপ দিয়ে বলে, হয়তো সেটাই ভাল হয়েছিল মাধুরী-বৌ। হয়তো লিখলে ওর মন উঠতো না। প্রত্যাশার পাত্রটা খালিই থেকে যেতো, অভিমানের সুখটা থেকেও বঞ্চিত হতো, যা হয়। হয়নি সেটাই ভাল।
তবু সময় পেলে একটু দেখো, তারপর ছিঁড়ে ফেলো, পুড়িয়ে ফেলে, যা তোমার খুশি। জগতের আর কারুর চোখে পড়লে মাধুরী নামের মেয়েটাকে হয়তো করুণা করতে বসবে। ভাববে, আহা বেচারী, বোধ হয় কিছুই পায়নি। তাদের তো বোঝানো যাবে না, এমন হৃদয়ও থাকে, যারা ফুরিয়ে যায় না, ফতুর হয়ে যায় না।
মাধুরী-বৌ ক্লান্তিতে চোখ বোজে।
বকুল ওই বোজা চোখের দিকে তাকিয়ে আর একটা মুখ মনে করতে চেষ্টা করে।
নামটা যেমন স্পর্শ করে যায়, মুখটা তেমন সহজে ধরা দেয় না।..অনেকটা ভাবলে তবে
কিন্তু সেই সরল-সরল ভীরু-ভীরু নির্বোধ মুখটার মধ্যে এমন কিছু আশ্বাস পায় না বকুল, যা মাধুরী পেয়েছে।.সত্যিই কি পেয়েছে? না ও শুধু ওর আপন মনের মাধুরী মিশায়ে রচনা করা মূর্তি?…
একটু পরে চোখ খুলে মাধুরী বলে, আজ তোমায় ডেলেছি সব কথা বলতে। অনেক প্রশ্ন করতে। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হচ্ছে, তোমার এই এত বড় জীবনে আর কখনো কোনো ভালবাসা আসেনি?
বকুল হেসে ওঠে, ওরে বাবা! এ যে দারুণ প্রশ্ন! চট করে তো মনে পড়ছে না।
ভেবে ভেবে মনে করো। এত প্রেমের কাহিনী লিখলে, আর…
হয়তো সেই জন্যেই লিখতে লিখতে আর সময়ই পেলাম না। তাছাড়া-বকুল একটু সহজ পরিহাসের মধ্য দিয়ে এ প্রসঙ্গে ইতি টানে, তোমার মতন সুন্দরী তো নই যে, মুগ্ধ ভক্তের দল পতঙ্গের মত ছুটে আসবে?
প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলে।
তা সেটাই ভাবো। তাতেও আমার প্রেস্টিজ বজায় থাকলো।
বলে উঠে দাঁড়ায় বকুল।
খাতাটা নিয়ে যাও!
সত্যই নিতে হবে?
বাঃ, তবে কি শুধু শুধু তোমায় ডেকে কষ্ট দিলাম? তোমার কাছে দিয়েই নিশ্চিন্ত হলাম।
৩৫. খাতাখানা এনে ড্রয়ারে পুরে রাখল বকুল
মাধুরী-বৌয়ের কাছ থেকে খাতাখানা এনে ড্রয়ারে পুরে রাখল বকুল। বকুলের ড্রয়ারে কখনো চাবির পাট নেই, তার জন্যে কোনোদিন কোনো অভাবও অনুভব করেনি।
আজই হঠাৎ মনে হলো, যেন ওটাকে চাবির মধ্যে বন্ধ করে রাখতে পারলেই ভাল হয়। না, কেউ বকুলের ড্রয়ারে হাত দেবে এ ভাবনা আর নেই, অনেক দিন হয়ে গেল, সেই সামাল-সামালের স্বাদ ভুলে গেছে বকুল।
লিখতে লিখতে আধখানা ফেলে রেখে গেলেও টেনে-উটকে পড়ে নিতো শম্পা। এখন বকুলের টেলিফোনে কদাচ কারো হাত পড়ে, বকুলের টেবিলে ড্রয়ারে হাত পড়ে না। এ বাড়িতে আরো ছেলেমেয়ে আছে, কিন্তু তারা বকুলের অচেনা। তারা এদিক মাড়ায় না।
তবু বকুলের মনে হল চাবি বন্ধ করে রেখে দিলে বুঝি স্বস্তি হত। যদিও খুলে দেখেনি এক পাতাও। থাক, কোনো এক সময়ের জন্যে থাক। আজ তো এক্ষুনি আবার বেরিয়ে যেতে হবে।
দেশবন্ধু হলে বাংলা সাহিত্য সম্মেলনের আজ বিশেষ বার্ষিক অধিবেশন।
সাহিত্যে অধোগতি হচ্ছে কিনা এবং যদি হয়ে থাকে তো প্রতিকার কী? এই নিয়ে তোড়জোড় আলোচনা চালানো হবে।
এ আলোচনায় অংশগ্রহণ করা অনামিকা দেবীর অবশ্যকর্তব্য। ঘন্টা-তিনেক ধরে অনামিকা দেবী এবং আরো অনেক দেব-দেবী বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ পন্থা নিরূপণ করে শেষ রায় দিয়ে যখন বেরোচ্ছেন, তখন একটি মেয়ে অনামিকার কাছে এসে নমস্কার করে দাঁড়াল।
অনামিকা চমকে উঠলেন, বৌমা? শোভনের বৌ, তুমি এসেছিলে এখানে?
হ্যাঁ।
কখন এসেছ? কোন্খানে বসেছিলে? দেখতে পাইনি তো?
আপনারা দেখতে পাবেন, এমন জায়গায় বসতে পাবো? শোভনের বৌ রেখা একটু হাসল, আমাদের কি সেই টিকিট?
কী মুশকিল! এর আবার টিকিট কি? সঙ্গে কেউ আছে নাকি?
তা তো আছেই। কারো শরণাপন্ন না হলে তো প্রবেশপত্র মিলতো না। আমার এক কবি মাসতুতো দাদার শরণাপন্ন হয়ে এসেছি।
বেশ করেছো। তুমি সাহিত্য-টাহিত্য বেশ ভালবাস, তাই না?
রেখা মৃদু হেসে বলে, সাহিত্যকে ভালবাসি কিনা জানি না, তবে একজন সাহিত্যিককে অন্ততঃ ভাল লাগে, তাই দেখতে এলাম তাকে।
অনামিকা হাসলেন।
কিন্তু–অনামিকা মনে মনে ভাবলেন, এটা কী হল? রেখা কি নরম হয়ে গেছে? রেখা কি বকুলকে মাধ্যম করে ওদের চিড়-খাওয়া জীবনটাকে মেরামত করে ফেলতে চায়?
অনামিকা ঠিক বুঝতে পারলেন না। অনামিকা সাবধানে বললেন, খুব রোগা হয়ে গেছো!
রেখা বলল, কই?
নিজে নিজে কি বোঝা যায়? ছেলেমেয়ে ভাল আছে?
বলেই মনে হলো জিজ্ঞেস না করলেই ভাল ছিল। কোথায় ছেলে, কোথায় মেয়ে, কে জানে!
কিন্তু রেখা বৌমা সে কথা বলল না।
সে শুধু মলিন একটু হেসে বলে, ভালই আছে বোধ হয়। খোকাকে তো শুনেছি আসানসোলে মিশন স্কুলের বোর্ডিঙে ভর্তি করে দিয়েছে।