ওঁর ঠিকানাটা তো তোরই হাতে।
তোমার হাতেও চলে যেতে পারে ছোড়দা, যদি তুমি সত্যিকার ক্ষমার হাতটা বাড়িয়ে দিতে পারো ওর দিকে।
ছোটবৌদি এসে দাঁড়াল।
বলল, ও-বাড়ির নির্মলের বৌ তোমায় ডেকেছে বকুল।
বকুল চকিত হয়।
আশ্চর্য, এখনো বকুল ‘নির্মল’ নামটা শুনলেই চকিত হয়! জগতে অনেক রহস্যের মধ্যে এ এক অদ্ভুত রহস্য, অনেক আশ্চর্যের মধ্যে এ এক পরম আশ্চর্য।
অবশ্য বকুলের এই গভীরে তলিয়ে থাকা চেতনায় চকিত হওয়া বাইরের জগতে ধরা। পড়ে না। বকুল সহজ ভাবে বলে, কেন ডেকেছে জানো?
ঠিক জানি না। তবে ওর সেই নাতিটাকে তো তার বাবা নিজের কাছে নিয়ে গেছে, মাকেও বোধ হয় নিয়ে যেতে ব্যস্ত। মজাটি জানো, ছেলেটার হাত কাটা গেছে বলে পার্টিতে আর ঠাই হয়নি। তারা নাকি বলেছে, অমন একটা চিহ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়ালে ধরা পড়ার সম্ভাবনা। ছেলেটা বলেছে, আর একটু শক্ত হয়ে উঠি, দেখে নেব ওদের। বিশ্বাসঘাতক হয়ে ওদের বিশ্বাসভঙ্গের শাস্তি দিয়ে ছাড়বে।
বকুল অন্যমনস্কের মত বলে, তাই বুঝি?
তাই তো। অলকা বৌমা যে গিয়েছিল একদিন। আর যারা সব আছে বাড়িতে তাদের সঙ্গে যে খুব ভাব বৌমার। ওখান থেকেই শুনে এসেছে।
নির্মলদার বৌ ভাল আছে?
জোর করেই মাধুরীবৌ না বলে নির্মলদার বৌ বললো বকুল। যেন সকলকে দেখাতে চাইলে (হয়তো নিজেকেও), ওই নামটা উচ্চারণ করা বকুলের কাছে কিছুই নয়। খুব সাধারণ।
ছোটবৌদি বললো, মোটেই নাকি ভাল নেই। চেহারা দেখলে নাকি চেনা যায় না। এই যা যাচ্ছে, আর ফিরবে বলে মনে হয় না।
কাছে গিয়ে খাটের ধারে বসে পড়ে বলে বকুল, তা চেহারাটা তো বেশ ভালই করে তুলেছ, ছেলের কাছে গিয়ে আর তাকে ভোগাবার দরকার কি? আর দু-দশদিন এখানে থাকলেই তো সরাসরি ছেলের বাবার কাছে চলে যেতে পারতে।
তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক বকুল–, মাধুরী-বৌ একটু হেসে বলে, অহরহই ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছি, যেন এই ঘর থেকে এই খাটবিছানা থেকেই তার কাছে চলে যেতে পারি। তা ছেলের আর তর সইছে না। হয়তো ভাবছে লোকনিন্দে হচ্ছে, কর্তব্যের ত্রুটি হচ্ছে–
বকুল একটু তাকিয়ে থেকে বলে, শুধু এই ভাবছে? আর কিছু ভাবতে পারে না?
মাধুরী-বৌ শীর্ণ হাতখানা বকুলের কোলে রেখে বলে, আর কি ভাববে?
কেন, মার কষ্ট হচ্ছে, মার অসুবিধে হচ্ছে, মার জন্যে মন কেমন করছে—
মাধুরী-বৌয়ের ঠোঁটের কোণে একটু হাসির রেখা দেখা দেয়। ব্যঙ্গতিক্ত অবজ্ঞার হাসি।
বকুল অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে।
এরকম হাসি হাসতে জানে মাধুরী-বৌ?
কিন্তু কথাটা খুব ভদ্রই বলে মাধুরী। বলে, তেমন হলে তো ভালই।
ডেকেছিলে?
হ্যাঁ, তোমার কত কাজ, তার মধ্যে অকারণ ডেকে বিরক্ত করলাম
বাজে সৌজন্যটুকু ছাড়ো তো! বলো কী বলবে?
বলব না কিছু
মাধুরী আস্তে বলে, একটা জিনিস দেব।
বকুলের এখনো বুক কেঁপে ওঠে, এ কী লজ্জা, এ কী লজ্জা!
মাধুরী-বৌ যদি তার স্বামীর একটা ফটোই বকুলকে দিতে যায়, ক্ষতি কি? বকুলের হঠাৎ কেন কে জানে ওই কথাই মনে এল।
কিন্তু ফটো নয়। খাতা।
অথবা ফটোও।
খাতার শেষ পৃষ্ঠায় ফটোও সাঁটা আছে।
ওঁর এই ডায়েরির খাতাটা–, মাধুরী বালিশের তলা থেকে খাতাটা বার করে বলে, ভেবে আর পাই না নিয়ে কী করি! হাতে করে ওই হাতের লেখাগুলো নষ্ট করতেও পারিনি প্রাণ ধরে, অথচ ভয় হচ্ছে সত্যিই যদি হঠাৎ মরে-টরে যাই, কে দেখবে কে পাতা ওলটাবে– তাই শেষ পর্যন্ত ভাবলাম, যার জিনিস তাকেই বরং দিয়ে দিই।
বকুল খাতাটায় হাত ঠেকায় না, অসহায় ভাবে বলে, যার জিনিস মানে?
অথচ বকুল প্রৌঢ়ত্বের শেষ সীমানায় এসে পৌঁছেছে, বকুল অনামিকা দেবীর খোলস এঁটে রাজ্য জয় করে বেড়াচ্ছে।
মাধুরী বিছানায় রাখা খাতাটা বকুলের কোলে রেখে দিয়ে বলে, যা বললাম, ঠিকই বলছি। পাতায় পাতায় যার নামাবলী, তারই জিনিস, তার কাছে থাকাই ঠিক।
হঠাৎ, মাধুরীর কোটরগত চোখের রেখায় রেখায় জল ভরে আসে। বকুল অপরাধীর মত কাঠ হয়ে বসে থাকে।
মাধুরীই আবার লজ্জার হাসি হেসে বলে, শরীরটা খারাপ হয়ে নার্ভগুলো একেবারেই গেছে। কথা বললেই চোখে জলটল এসে পড়ে। সত্যিই খাতাটা তোমার জন্যে তুলে রেখেছিলাম।
বকুল ওর রোগা হাতটা হাতে নিয়ে আস্তে বলে, ভেবে বড় সুখ ছিল, অন্ততঃ তোমার মধ্যে কোনো শূন্যতা নেই, ফাঁকি নেই!
মাধুরী রোগা মুখেও তার সেই অভ্যস্ত হাসিটি হেসে বলে, নেইই তো। সবটাই পূর্ণ, শুধু সেই পূর্ণতার একটা অংশ তুমি। তোমার ওপর আমি বড় কৃতজ্ঞ বকুল, তুমি আর সকলের মত ঘর-সংসার স্বামী-পুত্তর নিয়ে মত্ত হওনি। তেমন হলে হয়তো এ খাতা কবেই ছিঁড়ে ফেলে দিতে হত।
বকুল হাসবার চেষ্টা করে বলে, বর জোটেনি তাই ঘর-সংসারেরও বালাই নেই। তার মধ্যে ত্যাগের মহত্ব না খোঁজাই ভাল মাধুরী-বৌ। বরং তোমার কাছেই আমার–যাক, থাক সে কথা। সব কথা উচ্চারণে মানায় না। তবে যাবার দিন এসে না গেলে তো যাওয়া হয় না, অতএব সে দিনটা ত্বরান্বিত করার সাধনা না করাই উচিত!
না, তা করিনি। এমনিই কি মানুষের অসুখ-টসুখ করে না?…আচ্ছা ভাই, ওর খাতা পড়ে মতে হত-অবিশ্যি আগে কোনোদিনই পড়তাম না, তখন ভাবতাম সকলেরই একটুখানি নিভৃত জায়গা থাকা উচিত। কিন্তু যাবার আগে খাতাটা দিল। বলল, পড়ে দেখো। যাবার আগে তোমার কাছে নির্মল হয়ে যাই। নিজের নামটা নিয়ে অনেক সময় ঠাট্টা করতো তো। …তা পড়তে পড়তে মনে হতো, তোমাদের কথা নিয়ে কিছু লেখার কথা ছিল তোমার, লিখেছো কোথাও? তোমার কত বই, সব তো আর পড়িনি, জানতে ইচ্ছে করছে, কী লিখেছো তাতে?