শোভন শুকনো গলায় বলেছিল, অথচ শুধু আবদেরে আহ্লাদে ছেলে ছাড়া কোনোদিনই অন্য কিছু ভাবিনি ওকে।
পারুল মনে মনে বলেছিল, তার মানে তোমরাই গড়লে ওকে পিটিয়ে ইস্পাত করলে?
আশ্চর্য, চলে গেল যখন একটুকু বিচলিত ভাব নেই। সেই বালগোপালের মত কোমল সুকুমার মুখে কী অদ্ভুত কাঠিন্যের ছাপ! এরপর থেকে হয়তো এই একটা জাতি সৃষ্টি হবে, যারা মা-বাবাকে অস্বীকার করবে, বংশপরিচয়কে অস্বীকার করবে, হৃদযবৃত্তিকে অস্বীকার করবে। কঠিন মুখ নিয়ে শুধু নিজেদেরকে তৈরী করবে, পৃথিবীর মাটিতে চরে বেড়াবার উপযুক্ত ক্ষমতা আহরণ করে। আর সে ক্ষমতা অর্জন করতে পারলে বাপকে বলবে, আমাকে লেখাপড়া শেখাতে তোমার যা খরচ হয়েছে তা শোধ করে দেব।…অথবা বলবে, যা করেছে, করতে বাধ্য হয়েই করেছে। পৃথিবীতে এনেছিলেন আমাদের তার একটা দায়িত্ব নেই?
হয়তো ওইটুকুই তফাত থাকবে মানুষের জীবজগতের সঙ্গে। পশুপক্ষীরা তাদের জন্মের জন্যে মা-বাপকে দায়ী করতে জানে না, মানুষ সেটা জানে।
পারুল অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার ঘরে চলে এলো। কলমটা নিয়ে আবার লিখলো- কিন্তু এটাই কি চেয়েছিলেন সত্যবতী দেবী? তার সব কিছুর বিনিময়ে এই জবাবটা খুঁজে এনেছিলেন পরবর্তীকালের জন্যে?
পারুলের মনে পড়তে থাকে শোভনের সেই সমারোহময় জীবনের ছবিটি! বৌ ছেলে মেয়ে আর অগাধ জিনিস নিয়ে হয়তো একদিন কি একবেলার জন্যে মার কাছে এসে পড়া। একদিনের জন্যেও কত জিনিস লাগে ওদের ভেবে অবাক হতে পারুল। বৌ হেঁটে গেলে বোধ হয় বুকে বাজতো শোভনের, বৌয়ের এতটুকু অসুবিধা দূর করতে মুঠো মুঠো টাকা খরচ করতে দ্বিধা করতে না, আর অভিমানিনীর মুখটি এতটুকু ভার হলে যেন নিজে চোর হয়ে থাকতো, কাটা হয়ে থাকতো, মা পাছে তার বৌয়ের সূক্ষ্ম সুকুমার অনুভূতির মর্মটি বুঝতে পেরে ভোঁতা কোনো কথা বলে বসেন!
শোভনের জীবনে বৌয়ের প্রসন্নতা ছাড়া আর কিছু চাইবার আছে তা মনে হতো না। শোভনের হৃদয়ে বৌ ছাড়া আর কোনো কিছুর ঠাই আছে কি না ভাবতে হতো।
পারুল আবার লেখে, ভাবতাম অন্যদিকে যা হোক তা হোক, এই হচ্ছে প্রকৃত বিয়ে। একটা ভালবাসার বিয়ের সুখময় দাম্পত্যজীবনের দর্শক হয়েছি আমি, এ ভেবে আনন্দ বোধ হত।…দেখেছি আমাদের মায়ের জীবন, দেখেছি নিজেদের আর সমসাময়িকদের। কেউ ফাঁকিটা মেনে নিতে না পেরে যন্ত্রণায় ছটফটিয়েছে, কেউ ফাঁকির সঙ্গেই আপোস করে ঠাট বজায় রেখে চালিয়েছে।…তবে সত্য বলে কি কোথাও কিছু ছিল না? তা কি হয়? কি জানি! আমার ভাই-ভাজেদের তো দেখেছি, মনে তো হয়নি এরা ফকির বোঝা বয়ে মরছে! বাইরে থেকে কি বোঝা যায়? মোহনের কথা মনে পড়তে থাকে।
বহুকাল আসেনি ছেলেটা, সেই নাসিকে বদলি হবার পর থেকে আর এদিকে আসেনি। মনে তো হয় সুখী সমৃদ্ধ জীবনের স্বাদে ভরপুর হয়ে দিন কাটাচ্ছে সে। তাই পরিত্যক্ত আত্মীয়স্বজনদের একটা চিঠি লিখে উদ্দেশ করতেও মনে থাকে না। কিন্তু কে জানে-মোহনের জীবনেও তলে তলে কোথাও ভাঙন ধরবে কিনা!
ভেঙে পড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তো বাইরে থেকে কিছুই ধরা পড়ে না।
মোহনের জন্যে হঠাৎ ভারী মন কেমন করে উঠল। হয়তো শোভনের ব্যর্থ বিধ্বস্ত মুখোনাই মনটাকে উদ্বেল করে তুলেছে। রেখার জন্যেও খুব মন কেমন করে উঠেছে।
কতবার মনে হয়েছে, আমি কি রেখার কাছে যাবো? তাকে বলবো–কিন্তু কী বলবে ভেবে পায়নি পারুল। ওদের জীবনের ভার ওদেরই বহন করতে হবে। আর কারো কোনো ভূমিকা নেই সেখানে।
৩৪. বকুলের ছোড়দা বলে উঠলো
বকুল এ ঘরে আসতেই বকুলের ছোড়দা বলে উঠলো, ও বাড়ির বড়দা কেন এসেছিলেন রে?
বকুল অবাক হয়ে বলে, ওমা তুমি বাড়িতে ছিলে? তবে যে দেখা করলে না?
দূর, ছেড়ে দে! ওসব দেখাটেখা করার মধ্যে আমি নেই! বলেই ছোড়দা হঠাৎ মুখটা ফেরায়, ধরা গলায় বলে, লোকের কাছে দেখাবার মত মুখ কি আর আমার আছে বকুল?
বকুল হেসে উঠে বলে, অন্ততঃ ওঁর কাছে ছিল। ওঁর মতে, এ যুগে নিন্দের বলে কিছু নেই।
তারপর বড়দার আসার উদ্দেশ্য সংক্ষেপে বর্ণনা করে।
ছোড়দা একটুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে বলে, অথচ মনে হতো ওই বাড়িটা অচলায়তন। মুক্তকেশী দেবীর অস্থি পোঁতা আছে ও ভিটেয়।
থাকলে সেই পোঁতা অস্থিতে অবশই শিহরণ লাগছে।
আর আমরা কত নিন্দিত হয়েছি। আমাদের মা ওদের মত নয় বলে কত লাঞ্ছনা গেছে। তার উপর দিয়ে!
বকুল আস্তে বলে, আজও যাচ্ছে ছোড়দা। যারা একটু অন্যরকম হয়, তাদের ওপর দিয়ে লাঞ্ছনার ঝড় বয়েই থাকে। পরবর্তীকালে তোমার বংশধরেরাই হয়তো তোমাকে মুক্তকেশী দেবীর যোগ্য উত্তরসাধক বলে চিহ্নিত করবে।
ছোড়দা একটু চুপ করে থেকে বলে, আমি নিজের ভুল সংশোধন করতে চেয়েছিলাম বকুল, সুযোগ পেলাম কই?
সত্যি চেয়েছিলে?
ছোড়দার চোখ দুটো লাল হয়ে ওঠে। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলে, তোদের ছোটবৌদির কষ্ট আর চোখে দেখতে পারা যাচ্ছে না।
শুধু ছোটবোদির?
আমার কথা থাক্ বকুল।
কিন্তু এ সমস্যার সমাধান তো তোমাদের নিজেদের হাতে ছোড়দা।
সে কথা তো অহরহই ভাবছি, কিন্তু ভয় হয় যদি আমাদের ডাককে অগ্রাহ্য করে! যদি ফিরিয়ে দেয়!
বকুল মৃদু হেসে বলে, ওখানেই ভুল করছো ছোড়দা। তুমি যদি বলো, তুই আমায় কিছুতেই ফিরিয়ে দিতে পারবি না। আমিই তোকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো, যাবোই। দেখ কি হয়! কিন্তু মনে জেনো–ওর ভালবাসাকে অমর্যাদা করে নয়। ও যাকে জীবনে নির্বাচন করে নিয়েছে, তোমাদের কাছে হয়তো তার অযোগ্যতার শেষ নেই, কিন্তু যোগ্যতা অযোগ্যতা কি বাইরে থেকে বিচার করা যায় ছোড়দা?