বকুল হতাশ ভাবে বলে, কিন্তু আমার তো এমন কিছু জানাশোনা নেই।
এ তোমার এড়ানো কথা বকুল! আমি কি আর ভেতরের খবর না নিয়ে এসেছি? তুমি একবার বলে দিলেই হয়ে যাবে।
হয়তো হবে। কিন্তু বকুল সেই বলাটা বলবে কী করে?
অনেকক্ষণ অনুরোধ-উপরোধের পর বড়দা বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ে বললেন, তোমার লেখা বইটই আমি অবশ্য পড়িনি তবে বাড়িতে শুনিটুনি, বৌমাও বলেন খুব নাকি সংস্কারমুক্ত তুমি। অথচ এই একটা তুচ্ছ ব্যাপারে কুসংস্কারে তুমি আমাদের ঠাকুমা মুক্তকেশী দেবীর ওপর উঠলে! জীবিকার জন্যে মানুষের কত কীই করতে হয়, ‘পছন্দ নয়’ বলে কি আর বসে থাকলে চলে? আত্মীয়ের একটু উপকার করবে না তাই বলে? যাক, ও তো বলেছে নিজেই ওই অধিকারীর সঙ্গে দেখা করে চেষ্টা করবে। তোমার নিজের ভাইঝিটি তো একটা কারখানার মজুরের সঙ্গে বেরিয়ে গেছে, সেটায় মুখ হেঁট হচ্ছে না?
চলে গেলেন তিনি। বকুল বসে রইলো।
ভাবতে লাগলো মানুষ মরে গেলেও কি তার সত্যি কোথাও অস্তিত্ব থাকে? মুক্তকেশী দেবী নামের সেই মহিলাটি কি কোথাও বসে তার বংশের এই প্রগতি দেখছেন তাকিয়ে?
বকুল কি তাহলে সত্যিই খুব সংস্কারাচ্ছন্ন?
তবে বকুলের লেখা পড়লে সবাই তাকে একেবারে সংস্কারমুক্ত মনে করে কেন? বকুল কি ভেজাল?
যা ভাবে তা লেখে না? অথবা যা লেখে তা ভাবে না?
নাকি বকুলের হিসেবে প্রগতি শব্দটার অন্য মানে? সংস্কার শব্দটার অন্য ব্যাখ্যা?
বকুল অবাক হয়ে ভাবে, এত সহজে চিরকালীন মূল্যবোধগুলো এমন করে ঝরে পড়ছে কী করে? একদা যারা বংশমর্যাদা, কুলমর্যাদা, পারিবারিক নিয়ম ইত্যাদি শব্দগুলোর পায়ে জীবনের অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা আরাম-আয়েস বিসর্জন দিয়েছে, তারাই কেমন করে সেগুলো ভেঙে তার ভাঙা টুকরোগুলোকে মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে?
তবু বকুল বার বার ওই ‘মুক্তকেশী দেবী’ শব্দটার আশেপাশে ঘুরতে লাগল। একদার প্রতাপ কোথায় বিলীন হয়ে যায়, সম্রাটের রাজদণ্ড শিশুর খেলনা হয়ে ধুলোয় গড়াগড়ি খায়। জীবনের ব্যাখ্যা অহরহ পরিবর্তিত হয়, সত্য অবিরত খোলস বদলায়। অথচ তার মধ্যেই মানুষ অমরত্বের স্বপ্ন দেখে। চিরন্তন শব্দটাকে অভিধান থেকে তুলে দেয় না।
সুবিধেকে বলে সংসারমুক্তি, স্বার্থকে বলে সভ্যতা।
আমরা অচলায়তন ভাঙতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমরা হাতুড়ি শাবল গাঁইতির যথাযথ ব্যবহার শিখিনি, তাই আমরা আমাদের সব কিছু ভেঙে বসে আছি।
আজকের যুগ ওই গাঁইতি শাবল হাতে নিয়ে অনেক বড় বড় কথা বলছে, আর যথেচ্ছ আঘাত বসাচ্ছে। কথাগুলো বাতাসে উড়ে যাচ্ছে আর আঘাতে আঘাতে পায়ের তলার মাটিতে সুদ্ধ ফাটল ধরছে।
কিন্তু এসব কথা হাস্যকর।
মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলতে হবে, যা হচ্ছে তাই ঠিক। এই প্রগতি, এই সভ্যতা।
কলমের আগায় লিখতে হবে, এ কিছু না, এ শুধু সূচনা, আরো চাই। আরো এগোতে হবে, শেষ পর্যন্ত শেষে গিয়ে পৌঁছতে হবে।
কিন্তু কোথায় সেই শেষ?
শেষ নাহি যার শেষ কথা কে বলবে?
৩৩. নাম ছিল সত্যবতী দেবী
আমাদের মাতামহী–যাঁর নাম ছিল সত্যবতী দেবী, তিনি নাকি একদা এই প্রশ্ন নিয়ে দীর্ঘদিনের বিবাহিত জীবনের ঘর ছেড়ে পৃথিবীর আলোয় বেরিয়ে পড়েছিলেন, বিয়েটা কেন ভাঙা যায় না?
বলেছিলেন, এই কথারই জবাব খুঁজতে বেরিয়েছি আমি।
পারুল আর বকুল দুজনে যেন একই সঙ্গে একই কথা ভাবে, এই একটা আশ্চর্য!
পারুল তার খেয়াল-খুশির ডায়েরিতে লিখে চলে, কিন্তু সে কি আজকের এই বিয়ে? যে বিয়ে “ভালবাসা”র পতাকা উড়িয়ে লোকলোচনের সামনে জয়ের গৌরব নিয়ে নিজেদেরকে মালাবন্ধনে বাঁধে?
সত্যবতী দেবীর নয় বছরের মেয়ে সুবর্ণলতাকে নাকি লুকিয়ে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আর এই মহৎ কর্মের নায়িকা ছিলেন সুবর্ণলতার পিতামহী, সত্যবতীর শাশুড়ী। সত্যবতী বলেছিলেন, এ বিয়ে বিয়ে নয়–পুতুল খেলা
কিন্তু আজকের এই সভ্য সমাজের ভালবাসার বিয়ে! এরই বা পুতুল খেলার সঙ্গে তফাৎ কোথায়? খেলতে খেলতে পুরনো হয়ে গেলে, বৈচিত্র্য হারালে, আবার অন্য পুতুল নিয়ে খেলা শুরু, এই তো–আর যদি নতুন করে শুরু না-ও করো, খেলাটাই ত্যাগ করলে। খেলাটা ভাঙলে পুতুলটা আছড়ে ফেলে দিলে।
আমাদের বিদ্রোহিণী মাতামহী কি এই চেয়েছিলেন? তিনি কি আজ শোভনের এই মুক্তি দেখে উল্লসিত হভেন? বলতেন, যে বিয়ে মিথ্যে যে বিয়ে অর্থহীন, তার বোঝা বয়ে চলা মূঢ়তা মাত্র? শোভন ঠিক করেছে?
কিন্তু তাহলে সত্যি বিয়ে কোনটা?
আজ যা সত্য, আগামী কালই তো তা মিথ্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কলমটা রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো পারুল, বারান্দায় এসে দাঁড়াল। গঙ্গার ধারের সেই বারান্দা। পড়ন্ত বিকেলে গঙ্গার সেই অপূর্ব শোভা, জলে বাতাসের কাপন, তিরতির করে বয়ে চলেছে! অথচ গতকালই কালবৈশাখীর ঝড়ে কী তোলপাড়ই হচ্ছিল।
প্রকৃতি শক্তিময়ী, প্রকৃতি ঝড়ের পর আবার স্থির হতে জানে।
মানুষ মোচার খোলার নৌকোর মত ভেসে যায়, ডুবে তলিয়ে যায়।
রাজা চলে গেছে। মার কাছেও নয়, বাপের কাছেও নয়, চলে গেছে আসানসোলের এক বোর্ডিং স্কুলে।
অদ্ভুত অনমনীয় ছেলে!
কিছুতেই কলকাতায় থাকবে না সে।
অবশেষে রামকৃষ্ণ মিশনের ওই আসানসোল শাখায় ব্যবস্থা করতে হয়েছে শোভনকে।
পারুল হতাশ হয়ে বলেছিল, কী দিয়ে গড়া রে তোর ছেলে শোভন? পাথর না ইস্পাত?