কলকাতার বাইরে আসতে পেলে খুশী হন অনামিকা দেবী।
কিন্তু এবারের পরিস্থিতি অন্য হয়ে গেল।
অবশ্য সভায় এসে বসা পর্যন্ত যথারীতিই সুন্দর সৌষ্ঠবযুক্ত পরিবেশ ছিল। এয়ারপোর্ট থেকে আলাদা আলাদা গাড়িতে করে উদ্বোধক, প্রধান অতিথি এবং সভানেত্রীকে আলাদা আলাদা জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। সভানেত্রীকে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির বাড়িতে, উদ্বোধককে একটি বিশিষ্ট স্কুলবাড়িতে এবং প্রধান অতিথিকে স্বয়ং সেক্রেটারীর বাড়িতে!
আলাদা আলাদা করে রাখার কারণ হচ্ছে সম্যক যত্ন করতে পারার সুযোগ পাওয়া! ভা সারাদিন যত্নের সমুদ্রে হাবুড়ুবুই খাচ্ছিলেন অনামিকা দেবী। বাড়ির একটি বৌ কলকাতার মেয়ে, সে এতো বেশী বিগলিত চিত্তে কাছে কাছে ঘুরছিল, যেন তার পিত্ৰালয়ের বার্তা নিয়েই এসেছেন অনামিকা দেবী।
উত্তরবঙ্গে ইতিপূর্বে আসেননি অনামিকা দেবী, ভালই লাগছিল বেশ। অধিবেশনের পালা চুকলে যথারীতি আমন্ত্রিত অতিথিদের নিয়ে বহির্দৃশ্য দেখিয়ে আনার ব্যবস্থা আছে। সেটাও ভাল লাগছিল।
মোট কথা, কলকাতা থেকে আসার সময় যে ক্লান্তি এবং অবসাদ ধরনের একটা অনিচ্ছা গ্ৰাস করেছিল, এখানে এসে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই সেটা সহসা অন্তৰ্হিত হয়ে ভালই লাগিছিল আগাগোড়া। আর অবিরত একটা কথা মনে হচ্ছিল-কতখানি আগ্রহ আর উৎসাহ থাকলে এমন ভাবে হরিদ্বার-গঙ্গাসাগর এক করে এহেন একটি সম্মেলনের আয়োজন ঘটিয়ে তোলা সম্ভব হয়!
সেই আয়োজন ভয়ঙ্কর একটা নিষ্ঠুরতায় তছনছ হয়ে গেল।
এ নিষ্ঠুরতা কার?
মানুষের?
না ভাগ্যের?
গোলমাল শুরু হওয়ার প্রথম দিকে সম্পাদক এবং স্বয়ং অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতিও, একে একে মাইকে মুখ দিয়ে অমায়িক কণ্ঠে করজোড়ে প্রার্থনা করেছিলেন, আপনারা ক্ষান্ত হোন, আপনারা শান্ত হোন। আপনাদের যা বক্তব্য তা বলবার সুযোগ আপনাদের দেওয়া হবে। প্রতিনিধি স্থানীয় কেউ মঞ্চে উঠে আসুন।
কিন্তু সে আবেদন কাজে লাগেনি।
বাঁধ একবার ভেঙে গেলে কে রুখতে পারে উদ্দাম জনস্রোতকে?
প্রধান অতিথির ভাষণের সুরে ক্ষিপ্ত হয়ে যারা সভায় একটা ঢিল নিক্ষেপ করে চিৎকার করে উঠেছিল, বন্ধ করে দেওয়া হোক, বন্ধ করা দেওয়া হোক, এ কথা চলবে না। তারা ছাড়াও তো আরো অনেক ছিল। যাদের বক্তব্যও নেই, প্রতিবাদও নেই, আছে শুধু দুৰ্দম মজা দেখার উম্মাদ উল্লাস।
ভাঙবার এবং পোড়াবার কর্তব্যভার এরাই গ্রহণ করেছিল।
হয়তো বরাবর তাই করে।
এ দায়িত্ব এরাই নেয়।
সাদা-পোশাক-পরা পুলিসের মতো সর্বত্রই বিরাজ করে এরা শান্ত চেহারায়। প্রয়োজন না ঘটলে হয়তো দিব্য ভদ্রমুখে তারিয়ে তারিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত উপভোগ করে অথবা যন্ত্রসঙ্গীতে তাল দেয়। বড়জোর কোনো গায়িকার গানটা ভাল লাগলে, ভিড়ের মধ্যে থেকে-আর একখানা হোক না দিদি-বলে চেঁচিয়ে উঠেই ঝুপ করে আবার বসে পড়ে। এর বেশী নয়।
কিন্তু প্রয়োজন ঘটলে?
বাধা ভাঙলে?
মুহূর্তে ওদের কর্তব্যবোধ সজাগ হয়ে ওঠে। ওরা সেই ভাঙা বাঁধ আরো ভেঙে বন্যার স্রোতকে ঘরের উঠোনে ডেকে আনে। রেলওয়ে স্টেশনের কুলিদের মতো নিজেরাই হট্টগোল তুলে ঠেলা ঠেলি গুতোগুতি করে এগিয়ে যায় চেয়ার ভাঙতে, টেবিল ভাঙতে, মণ্ডপে আগুন ধরাতে।
ও রাস্তা শুধু ওই প্রথমটুকুর।
সেটুকু করেছিল বোধ হয় অতি প্ৰগতিবাদী কোনো দুঃসাহসিক দল। তারপর যা হবার হলো।
মাইকের ঘোষণা, করজোড় প্রার্থনা কিছুই কাজে লাগলো না, ঢিলের পর ঢিল পড়তে লাগলো ঠকাঠক।
অতএব উদ্যোক্তারা তাদের পরম মূল্যবান অতিথিদের নিয়ে পালিয়ে প্রাণ বাঁচালেন। সেক্রেটারীর বাড়ি মণ্ডপের কাছে, সেখানে এই বিশেষ তিনজন এবং অবিশেষ কয়েকজন এসে আশ্রয় নিলেন, এবং সেখান থেকেই মণ্ডপের মধ্যেকার কলরোল শুনতে পেলেন।
যাঁরা অনেক আগ্রহ নিয়ে, অনেক আয়োজন করে হয়তো দূর-দূরান্ত থেকে সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছিলেন, তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেন, শিশু বৃদ্ধ মহিলা নির্বিশেষে দিগ্বিদিকে ছুটলেন।
কারণ কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাঙা-পর্ব শেষ করে জ্বালানোর কাজে আত্মনিয়োগ করেছিল তারা।
যাদের মাইক তারা বেগতিক দেখে দড়িদড়া গুটিয়ে নিয়ে সরে পড়ছিল, তাদেরই একজনের হাত থেকে একটা মাইক কেড়ে নিয়ে কোনো একজন কর্তব্যনিষ্ঠ তারস্বরে গান জুড়েছিল, জীর্ণ প্ৰাণের আবর্জনা পুড়িয়ে দিয়ে আগুন জ্বালো…আগুন জ্বালো…আগুন জ্বালো।
এখান থেকে শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল সে গান।
অমলেন্দু ঘটক ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বললেন, রবীন্দ্রনাথ সকলের, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। …সকলের জন্যেই তিনি গান রেখে গেছেন।
তাড়াতাড়ি মঞ্চ থেকে নামতে গিয়ে কোঁচায় পা আটকে হোঁচট খেয়ে তাঁর চশমাটা ছিটকে কোথায় পড়ে গিয়েছিল, তাই চোখ দুটো তার কেমন অদ্ভুত অসহায়-অসহায় দেখতে লাগছে।
উদ্বোধক বললেন, আমার মনে হয় এটা সম্পূর্ণ পলিটিক্স।
সেক্রেটারীর কান এবং প্ৰাণ সেই উত্তাল কলরোলের দিকে পড়েছিল, তবু তিনি এদের আলোচনায় যোগ দেওয়া কর্তব্য মনে করলেন। শুকনো মুখে বললেন, ঠিক তা মনে হচ্ছে না। পাড়ায় কতকগুলো বদ ছেলে আছে, তারা বিনে পয়সায় জলসার দিনের টিকিট চেয়েছিল, পায়নি। শাসিয়ে রেখেছিল, আচ্ছা আমরাও দেখে নেব। সভা করা ঘুচিয়ে দেব।—তখন কথাটায় গুরুত্ব দিইনি, এখন বুঝছি শনি আর মনসার পুজো আগে দিয়ে রাখাই উচিত।