শোভন নিজে ইচ্ছে করে মেয়ের নতুন নতুন অবস্থার আর বয়সের ফটো মাকে পাঠায়। তাই থেকেই জেনেছে পারুল মেয়েটা এখন ইউনিফর্ম পরে স্কুলে যেতে শুরু করেছে!
সুখে থাক, ভাল থাক, তবু তো এই ভালবাসাটুকুও রেখেছে শোভন মার জন্যে।
পারুল ওদের কাছে কৃতজ্ঞ।
পারুল তার পরলোকগত স্বামীর প্রতিও কৃতজ্ঞ, এই বারান্দাটির জন্যে।
এইখানে
যখন পড়ন্ত বিকেলের আলো মুখে মেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছিল কী আশ্চর্যের তুলনাই রেখে গেছেন কবি!
ওই যেথা জ্বলে সন্ধ্যার কুলে দিনের চিতা।
দিনের চিতা! কী অভাবনীয় মৌলিক!
আগে কী কেউ কখনো দেখেছিল এই চিতাকে?
বহুদিনের পড়া, মুখস্থ করা এই কবিতাটাই হঠাৎ যেন নতুন একটা অর্থ বহন করে এসে দাঁড়িয়েছে, পারুল সে অর্থকে কোথায় যেন মিলোচ্ছে, সেই সময় অনামিকা দেবীর চিঠিখানা এলো।
বকুলের স্কুলের খাতাটা আমি খুঁজে পাচ্ছি না, তুই খুঁজে দেখিস।
বকুলের সেজদিকে কিছু খুঁজে দেখতে হয় না।
সেজদির সিন্দুকে সব তোলা থাকে। কে জানে সিন্দুকটা সেজদির কত বড়!
সেজদির চিঠিটা হাতের মুঠোয় চেপে রেখে মনে মনে বললেন, আছে আমার কাছে তবে। সবটা নয়, অনেকটা। কিন্তু আমি সেটা বার করে কী করবো? আমি কি লিখতে পারি?
লিখতে পারেন না সেজদি।
কবিতা পারেন, গদ্য নয়।
তাই মনে মনে উচ্চারণ করেন, আমি খুঁজে পেয়ে কী করবো?
তারপর বলেন, বকুল বলেছিল নিজেদের কথা আগে বলতে নেই। আগে পিতামহী প্রপিতামহীর ঋণ শোধ করতে হয়।…সে ঋণ তবে শোধ করছে না কেন বকুল? না কি করেছে া কখন, সেও আমার অসতর্কতায় চোখ এড়িয়ে গেছে?
০৬. উত্তরবঙ্গের সাহিত্য সম্মেলন
উত্তরবঙ্গের সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হলো।
তিনদিন ব্যাপী অধিবেশনের প্রথম দিনেই অধিবেশনের মধ্যকালে প্রধান অতিথির ভাষণ উপলক্ষ করে উদ্দাম এক হট্টগোল শুরু হয়ে সভা পণ্ড হয়ে গেল।
আর শুধু যে সেদিনের মতই গেল তা নয়, আগামী কাল পরশুর আশাও আর রইল না। কারণ পরিস্থিতি শোচনীয় তো বটেই, আশঙ্কাজনকও। এই সামান্য সময়েরই মধ্যেই সভা-সজ্জা ভেঙেচুরে পুড়ে এমনই তছনছ হয়ে গেছে যে, তার থেকে সম্মেলনের ভবিষ্যৎ ললাটলিপি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
ভয়ঙ্কর হৈ-চৈটা কমলে দেখা গেল সভায় সাজানো ফুলদানি ভেঙেছে, মঙ্গলঘট ভেঙেছে, বরেণ্য মনীষীদের ছবি ভেঙেছে, কাঁচের গ্লাস ভেঙেছে, সেক্রেটারীর বাড়ি থেকে সভাপতি প্রধান অতিথি আর উদ্বোধকের জন্য আনীত চেয়ার টেবিল ভেঙেছে এবং অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির নাকের হাড় ভেঙেছে।
পুড়েছে প্যাণ্ডেলের বাঁশ, ডেকরেটারের পর্দা চাঁদোয়া, স্থানীয় এক তরুণ শিল্পীর বহু যত্নে তৈরী মণ্ডপের রূপসজ্জা এবং পরোক্ষে সম্মেলন আহ্বানকারীদের কপাল। এই সম্মেলনকে সাফল্যমণ্ডিত করতে অর্থ এবং সামর্থ্য তো কম ব্যয় করেননি তারা।
আয়োজনে ত্রুটিমাত্র ছিল না।
বিশেষ আমন্ত্রিতদের সময় ও শ্রম বাঁচাতে, এরা তাদের কলকাতা থেকে আনার জন্যে আকাশযানের ব্যবস্থা করেছিলেন, আকাশ থেকে ভূমিষ্ঠ হবামাত্র উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনির ব্যবস্থা রেখেছিলেন, মাল্যে চন্দনে তিলকে ভূষিত করে সসম্মানে গাড়িতে তুলিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের বিশ্রাম নিকেতনে।
তাদের শ্রম না হলেও শ্রম অপনোদনের প্রচুর বাবস্থা ছিল, আর তার সঙ্গে ছিল কৃতকৃতার্থের ভঙ্গী।
বাংলা সাহিত্যের ওই শ্রেষ্ঠ শ্রেষ্ঠ দিকপালেরা যে নিজ নিজ বহু মূল্যবান সময় ব্যয় করে উত্তর বাংলার এই সাহিত্য-সম্মেলনকে গৌরবান্বিত করতে এসেছেন এতে স্থানীয় আহ্বানকারীদের যেন কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
প্রধান অতিথিই অবশ্য মধ্যমণি, বাকিরাও সঙ্গগুণে প্ৰাপ্যের অতিরিক্তই পেয়েছেন। অন্ততঃ অনামিকা দেবী তাই মনে করেছেন—এ নৈবেদ্য অমলেন্দু ঘটকের জন্যে—আমরা সর্বদেবতার একজন।
তা সৎসঙ্গে স্বৰ্গবাস, এ তো শাস্ত্রের বচন।
অনামিকা দেবী নিজে একথা ভাবলেও স্থানীয়রা তাকে অমলেন্দু ঘটকের থেকে কিছু কম ন্তব করছিল না। বিশেষ করে মহিলা-পাঠিকা কুল। অনামিকা দেবীর লেখায় নাকি তারা অভিভূত, বিচলিত, বিগলিত। তিনি নাকি মেয়েদের একেবারে হৃদয়ের কথা বুঝে লেখেন। মেয়েদের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, আশা-হতাশা, ব্যর্থতা-সার্থকতা অনামিকা দেবীর লেখনীতে যেমন ফোটে তেমন বুঝি আর কারো নয়।
উচ্ছাসের ফেনাটা বাদ দিলেও, এর কিছুটা যে সত্যি, সে কথা অনামিকা দেবী কলকাতার বাইরে সুদূর মফঃস্বলে সভা করতে এসে অনুভব করতে পারেন। যারা দূর থেকে শুধু লেখার মধ্যে তাঁকে চিনেছে, ভালবেসেছে, তাদের ভালবাসাকে একান্ত মূল্য দেন অনামিকা দেবী।
কলকাতায় থাকেন, সেখানেও অজস্র পাঠিকা, কে বা তাকে দেখতে আসে, কিন্তু এসব জায়গায় যেন এরা তাঁকে একবারটি শুধু চোখে দেখবার জন্যেই পাগল।
এই আগ্রহে উৎসুক মুখগুলির মধ্যেই অনামিকা দেবী তাঁর জীবনব্যাপী সাধনার সার্থকতা খুঁজে পান। মনে মনে বলেন, হ্যাঁ আমি তোমাদের লোক। তোমাদের নিভৃত অন্তরের কথাগুলি মেলে ধরবার জন্যেই আমার কলম ধরা। আমি যে দেখতে পাই ভয়ঙ্কর প্রগতির হাওয়ার মধ্যেও জায়গায় জায়গায় বন্দী হয়ে আছে সেই চিরকালের দুৰ্গতির রুদ্ধশ্বাস। দেখতে পাই আজও লক্ষ লক্ষ মেয়ে-সেই আলোহীন বাতাসহীন অবরোধের মধ্যে বাস করছে। এদের বাইরের অবগুণ্ঠন হয়তো মোচন হয়েছে, কিন্তু ভিতরের শৃঙ্খল আজও অটুট।