শোভনের মা হালকা গলায় হেসে বললেন, নাঃ, তুই দেখছি বড্ড রেগে যাচ্ছিস। কিন্তু সত্যিই রে, কদিন ধরে কেবলই সেই গঙ্গা-গঙ্গা মন করছে।
শোভন বললো, আচ্ছা ঠিক আছে। মানে সব চেয়ে বেঠিকের সময় যে কথাটা বলে লোকে। ঠিক আছে—অর্থাৎ ঠিক নেই।
সেজদির ছেলে কি মাকে নিষ্ঠুর ভাবলো না? সে কি মনে করলো না-মা আমার মনের দিকটা দেখলেন না? মার অহমিকাটাই বড় হলো? জানি রেখা তেমন নম্র নয়, কিন্তু করা যাবে কি? সবাই কি সমান হয়? আমি ওকে নিয়ে ঘর করছি না?
হয়তো শোভনের মা ছেলের মুখের রেখার এই ভাষা পড়তে পারলেন, কিন্তু তিনি বলে উঠতে গেলেন না, ওরে তুই যতটুকু দেখতে পাস, সেইটুকুই সব নয়।
শোভনের মা সমন্ত অপরাধের বোঝা নিজের মাথায় তুলে নিয়ে হাস্যমুখে ছেলের বাড়ি থেকে সরে এলেন। এই সরে আসাটা কি অপরাধ হলো পারুলের? অনামিকা দেবীর সেজদির? মোহন-শোভনের মার?
তা অপরাধী বৈকি।
ছেলে-বৌয়ের একান্ত ভক্তির নৈবেদ্য পায়ে ঠেলে একটা তুচ্ছ মান অভিমান নিয়ে খরখরিয়ে চলে যাওয়াটা অপরাধ নয়?
আশেপাশে সমন্ত কোয়ার্টারের বাসিন্দারা এই হঠাৎ চলে যাওয়ায় অবাক হয়ে প্রশ্ন করতে গিয়ে আরো অবাক হল।
একদিন বৌ শাশুড়ীর রাত্রের আহারের ক্ষীর করে রাখতে ভুলে গিয়ে বেড়াতে চলে গিয়েছিল বলে, চলে যাবে মানুষ ছেলের বাড়ি ছেড়ে? ছিঃ!
কেউ কেউ বললো, দেখলে কিন্তু ঠিক এরকম মনে হতো না।
রেখা মুখের রেখার অপূর্ব একটি ব্যঞ্জনা ফুটিয়ে বললে, বাইরে থেকে যা দেখা যায় তার সবটাই সত্যি নয়।
আশ্চর্য!
আশ্চর্য কিছুই নয়, বড় ছেলের সংসারেও তো ঠিক এই করেছিলেন!
যারা পারুলকে ভালবাসতো, তারা একটু মনঃক্ষুন্ন হল, যারা বান্ধবীর শাশুড়ীকে বা বন্ধুর মাকে ভালবাসার মতো হাস্যকর ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায় না, তারা শুধু খানিকটা নিন্দে করলো।
তারপর আর শোভনের সংসারে শোভনের মার অস্তিত্বের কোনো স্মৃতি রইল না। শোভনের জন্যে সেই আধবোনা সোয়েটারটা অনেকদিন পর্যন্ত ট্রাঙ্কের উপর পড়ে থাকতে থাকতে কোথায় যেন হারিয়ে গেল।
শোভনের দামী কোয়ার্টারে সুন্দর লন, গেঞ্জি-ট্রাউজার পরা সাহেবদের এবং কোমরে আঁচল জড়ানো মেমসাহেবদের টেনিস-কল্লোলে-মুখরিত হতে থাকলো, শোভনের খাবার টেবিল প্রায়শই নিমন্ত্রিত অতিথির অভ্যর্থনার আয়োজনে প্ৰফুল্লিত হতে থাকলো, শোভনের ঘর যখন তখন রেখার উচ্ছ্বসিত হাসিতে মুখরিত হতে থাকলো।
তবে আর শোভন তার ভিতরের একটি বিষণ্ণ শূন্যতাকে লালন করে করে দুঃখ পেতে যাবে কেন?
হৃদয়ভারাবনত জননী, আর অভিমান উত্তপ্ত স্ত্রী, এই দুইয়ের মাঝখানে অপরাধীর ভূমিকা নিয়ে পড়ে থাকায় সুখই বা কোথায়? একটাকে তো নামাতেই হবে জীবন থেকে?
০৫. ট্রেনের জানলায় মুখ রেখে
ফেরার পথে পারুল ট্রেনের জানলায় মুখ রেখে বাইরের গভীর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভেবেছিল, ধারণা ছিল যুগের নিয়ম অনেকটা সিঁড়ির নিয়মের মত। সে ধাপে ধাপে পরিবর্তিত হতে হতে চলে…তা হলে কি আমার অন্যমনস্কতার অবকাশে একটা যুগ তার কাজ করে চলে গেছে, আমি খেয়াল করিনি?
নইলে সে যুগটা কোথায় গেল?
আমার যুগটা? আমি আমার মাকে দেখেছি।–দেখেছি জেঠিমা কাকিমা পিসিমাদের, দেখেছি, আমার শাশুড়ী খুড়শাশুড়ীদের। ওপরওয়ালার জাঁতার তলায় নিষ্পিষ্ট সেই জীবনগুলি শুধু অপচয়ের হিসেব রেখে চলে গেছে…আমরাও আমাদের বধূজীবনে সেই অপচয়ের জের টেনেই চলে এসেছি আর ভেবেছি আমাদের কাল আসতে বুঝি বাকি আছে এখনো। সেই আসার পদধ্বনির আশায় কান পেতে বসে থাকতে থাকতে দেখছি আমরা কখন যেন বাতিলের ঘরে আশ্রয় পেয়ে গেছি!
সে কাল টা তবে গেল কোথায়?
যেটার জন্যে আমাদের আশা ছিল, তপস্যা ছিল, স্বপ্ন ছিল?
এখন যাদের কাল তারা একেবারে নতুন, একেবারে অপরিচিত। তাদের কাছে গিয়ে খোঁজ করা যায় না, হাঁ গো সেই কালটা কোন ছিদ্র দিয়ে গলে পড়লো? দেখতে পাচ্ছি না তো? আমার তপস্যাটা তাহলে স্রেফ বাজে গেল?
আমরা মেয়েরা লড়াই করেছিলাম—
মনে মনে উচ্চারণ করেছিল পারুল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, উৎপীড়নের বিরুদ্ধে, অযথা শাসনের বিরুদ্ধে, পরাধীনতার বিরুদ্ধে-আমি, আমার পূর্বতনীরা।….
সেই লড়াইয়ে তবে জিত হয়েছে আমাদের।
সব শক্তি হাতে এসে গেছে মেয়েদের। সব অধিকার।
…শুধু প্রকৃতির অসতর্কতায় আমাদের ভাগটা পেলুম না। আমার যুগটা কখন স্খলিত হয়ে পড়ে গেছে।
তবে আর কী করবো?
প্রত্যাশার পাত্রটা আর বয়ে বেড়াবো কেন?
জানলাটা বন্ধ করে একখানা বই খুলে বসেছিল পারুল, তার মুখে একটা সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠেছিল। ভেবেছিল, এ যুগের নাটকে তবে আমাদের ভূমিকা কি? কাটা সৈনিকের? স্টেজে আসবার আগেই যাদের মরে পড়ে থাকতে হয়?
কিন্তু ওসব তো অনেকদিন আগের কথা। তখন তো শোভনের ওই ডল পুতুলের মত মেয়েটা জন্মায়নি। যাকে নিয়ে এসে দেখিয়ে গেল সেবার শোভন আহ্লাদে গৌরবে জ্বল-জ্বল করতে করতে। কত বকবক করে গেল মেয়ের অলৌকিক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে।
মেয়েটাকে দেখে সত্যিই বুক ভরে উঠেছিল পারুলের। মনে হয়েছিল এমন একটা অনিন্দ্যসুন্দর বস্তুর অধিকারী হতে পারা কী সৌভাগ্যের!
কিন্তু চলে যাবার সময় তো কই বলে ওঠেনি, আবার আনিস রে! চলে যাওয়ার পর এই এতোদিনের মধ্যে তো কই চিঠিতে অনুরোধ জানায়নি, আর একবার বড় দেখতে ইচ্ছে করছে রে!