সেজদির বড় ছেলের নাম মোহন।
তাই সেজদি এই মহিলাকুলের অনেকের কাছেই মোহনের মা নামে পরিচিত।
সেজদির স্বামী অমলবাবুর বদলির চাকরি ছিল, জীবনের অনেকগুলো দিনই সেজদির বাইরে বাইরে কেটেছে, শেষের দিকে অমলবাবু দেশের পোড়ো ভিটের সংস্কার করে, গঙার ধার ঘেঁষে এই বারান্দাটি বানিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এ বারান্দা তোমার জন্যে। তুমি কবি মানুষ। স্বামী সেজদিকে ভালবাসতেন বৈকি, খুবই ভালবাসতেন, কিন্তু তার নিজস্ব ধরনের সেই ভালবাসা-কিন্তু ও কথা থাক। পৃথিবীতে কত মানুষ, কে কার ছাঁচে ঢালা?
কেউ না।
তবু যারা বুদ্ধিমান, তারা সুবিধে আর শান্তির মুখ চেয়ে নিজের ধারালো কোণগুলো ঘষে ক্ষইয়ে ভোঁতা করে নিয়ে অন্যের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। নিয়ত সংঘর্ষের হাত এড়ায়।
তারা জানে সংসার করার সাধ থাকলে, ওই ধারালো কোণগুলো তো থাকবে না, যাবেই ক্ষয়ে। শুধু সেটা যাবে নিয়ত সংঘর্ষের যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতায়। তার থেকে নিজেই ঘষে নিই।
আর যারা বুদ্ধিমান নয় এবং সংঘর্ষকে ভয় পায়, তারা একপাশে সরে থাকে, নিজেকে নিয়ে গুটিয়ে থাকে। তারা কদাচ কখনো একটি মনের মতো মন পেলে, তবেই সেখানে নিজেকে খোলে।
সেজদি বুদ্ধিমতী নয়।
সেজদি এদের দলে।
সেজদি তাই ওই তারকের মা, ফুলকুমারীদের সঙ্গে একথা বলে তর্ক করতে বসেন না, আপনাদের শ্ৰীহরির গোলোক বৈকুণ্ঠে কি অন্য বিছানা জোটেনি? মা-লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ফাঁকা? তাই ভদ্রলোককে কলমি-পটলের শরণাপন্ন হতে হয়? অথবা এ তর্কও করেন না, বাড়িতে যদি শুধু বিধবা মা আর ছেলেরা থাকে, মা ওই আগুন-নিষেধ পালন করতে না খাইয়ে রাখবে তাদের? রেঁধে দেবে না? কথাগুলো তো মনে এসেছিল সেজদির।
হয়তো সেজদি এই তর্ককে বৃথা শক্তিক্ষয় বলে মনে করেন, অথবা সেজদি ওই মহিলা দলের সমালোচনাকে তেমনি গুরুত্ব দেন না। হয়তো তাদের তেমন গ্রাহ্য করেন না।
সেজদিকে বাইরে যতই অমায়িক মনে হোক, ভিতরে ভিতরে হয়তো দস্তুর মতো উন্নাসিক।
তাই তিনি ছেলেদের বিদায়দানকালে কখনো চোখের পাতা ভিজে করেন না, কখনো আবার শীগগির আসিস বলে সজল মিনতি জানান না।
হাসি-কথার মধ্য দিয়েই তাদের বিদায় দেন।
নাতি-নাতনীদের যে তার দেখতে খুব ইচ্ছে হয়, তারা এলে যে মনটা ভরে ওঠে, একথা সেজদির মোহন শোভন জানে না। তাই তারা খেয়ালও করে না, মায়ের কাছে নিয়ে যাই ওদের।
শুধু শোভনের মেয়েটা বড় বেশী সুন্দর দেখতে হয়েছে বলে একবার দেখাতে নিয়ে এসেছিল। শুধু মোহনের ছোট ছেলের একবার পক্স হওয়ায় বড়টিকে মার কাছে কিছুদিনের জন্য রেখে গিয়েছিল। ছেলের দিদিমারা তখন সপরিবারে তীর্থে গেছেন।
আসানসোলে থাকে মোহন, খুব একটা দূরত্ব তো নয়।
শোভন অনেক দূরে।
শোভনের দূরত্ব ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। মাইলের হিসেব দিয়ে সে দূরত্বকে আর মাপা যাচ্ছে না।
অথচ আগে শোভনই মার বড় নিকট ছিল। শোভনই প্রথম ভাল আর বড়ো কোয়ার্টার পাওয়া মাত্ৰই মাকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিল।… বলেছিল, তোমার একা পড়ে থাকা চলবে না।
কিন্তু শোভনের এই বোকাটে সেণ্টিমেণ্ট শোভনের বৌ সহ্য করবে কেন? বরের ওই আহ্লাদেপনার তালে তাল দিতে গেলে তার নিজের জীবনের সব তাল বেতাল হয়ে যাবে না? সব ছন্দপতন হয়ে যাবে না?
তার এই ছবির মতো সাজানো সংসারে শাশুড়ী বস্তুটা একটা অদ্ভুত ছন্দপতন ছাড়া আর কি?…দুচার দিনের জন্যে এসে থাকো, আদর করবো যত্ন করবো, ব্যবহার কাকে বলে তা দেখিয়ে দেব। কিন্তু শেকড় গাড়তে চাইলে?
অশ্বখের চারাকে চারাতেই বিনষ্ট করতে হয়।
আদুরে বেড়ালকে পয়লা রাত্তিরেই কাটতে হয়।
শোভনের বৌ জানতো একথা।
শোভনের বৌ তার জানা বিদ্যেটা প্রয়োগ করতে দেরি করেনি।
হয়তো কিছুটা দেরি করতো, হয়তো একবারও শোভনতা-অশোভনতার মুখ চাইতো, যদি শাশুড়ী তার সাধারণ বিধবা বুড়ীর মত ভাঁড়ার ঘর পুজোর ঘরের মধ্যেই নিমগ্ন থাকতো। যদি কৃতী ছেলের বৌয়ের সঙ্গে যেমন সসম্ভ্রম ব্যবহার করতে হয় তা করতো, যদি ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার পদ্ধতিতে বৌকে ডিঙিয়ে ছেলের সঙ্গে বসে গল্প না জুড়তো।
কিন্তু শোভনের নির্বোধ মা সাহেব ছেলেকে সাহেবের দৃষ্টিতে না দেখে ছেলের দৃষ্টিতে দেখতে গেলেন। শোভনের মা ভাঁড়ার ঘর পুজোর ঘরের ছায়াও না মাড়িয়ে ড্রইংরুমে এসে সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়তে শুরু করলেন, পশম বুনতে শুরু করলেন।
বুনলেন অবশ্য শোভনের জন্যেই, কিন্তু কে চায় সে জিনিস? বৌ কি বুনতে জানে না? আর সেই জানাটা জানাবে না?
.
সেজদি তাই ছেলেকে বললেন, বললে তুই আমায় মারবি শোভন, আমার কিন্তু গঙ্গার ধারের সেই বারান্দাটার জন্যে বেজায় মন-কেমন করছে। আমায় বাবু একটু পৌঁছে দিয়ে আয়। তোর ছুটি না থাকে তোর চাপরাসী-টাসী কাউকে দিয়ে—
শোভন হয়তো ভিতরে ভিতরে কিছুটা টের পাচ্ছিল, শোভন হয়তো একটা অদৃশ্য উত্তাপের মধ্যেই কাটচ্ছিল, কিন্তু অকস্মাৎ এতটার জন্যে প্ৰস্তুত ছিল না। মায়ের শক্তির উপর আস্থা ছিল তার।
শোভনের অতএব অভিমান হল।
হয়তো শোভন তার মায়ের প্রকৃতিই বেশী পেয়েছে। তাই শোভন হাঁ হাঁ করে উঠলো না। শোভন শুধু বললো, আজই যেতে চাও?
কী মুশকিল! আজই কি রে! কাল পরশু তোর সুবিধে মতো-
থাকাটা একেবারেই অসম্ভব হলো?