সেজদি এতো কথার উত্তরে শুধু মৃদু হেসে বলেন, আমার রান্নার ভারী বহর!
সেজদি অল্প কথার মানুষ।
অনেক কথার উত্তরে ছোট দুএকটি লাইনেই কাজ সারতে পারেন। মহিলারা নিজেই অনেক কথা বলে, তারপর যাই দিদি, আপনার অনেক সময় নষ্ট করে গেলাম বলে চলে যান।
সেজদি এ কথাতেও হৈ-হৈ করে প্রতিবাদ করে ওঠেন না। শুধু তেমনি হাসির সঙ্গে বলেন, আমার আবার সময় নষ্ট! সারাক্ষণই তো সময়!
গমনোন্মুখ মহিলাকুল আবার থমকান, ঈষৎ ঈর্ষা আর ঈষৎ প্রশংসায় বলে ওঠেন, কি জানি ভাই, কি করে যে আপনি এতো সময় পান! আমরা তো এতোটুকু সময় বার করতে হিমসিম খেয়ে যাই! ইহ-সংসারের খাজনা আর শেষ হয় না! •
সেজদি এ উত্তর দিয়ে বসেন না, খাবেন না কেন হিমসিম, কাজের তালিকা যে আপনাদের বিরাট। নিত্য গঙ্গা নাইবেন, নিত্য যেখানে যত বিগ্ৰহ আছেন তাদের অনুগ্রহ করতে যাবেন, নিত্য ভাগবত পাঠ শুনতে বেরোবেন। তাছাড়া বাড়িতেও কেউ এক ডজন ঠাকুর নিয়ে ফুলচন্দন দিতে বসবেন, কেউ তুলসীর মালা নিয়ে হাজার জপ করতে বসবেন।
নিত্য এতগুলি নিত্যের নৈবেদ্য যুগিয়ে তবে তো আপনারা অনিত্য ইহ-সংসারের খাজনা দিতে বসেন। তার মধ্যেও আছে ইচ্ছাকৃত কাজ বাড়িয়ে তোলার ধরন! ভরা জল আবার ভরা, মাজা কলসী আবার মাজা, কাচা কাপড়কে আকাচা সন্দেহে আবার কাচা, এসব বাদেও—তুচ্ছ জিনিসকে উচ্চমূল্য দিতে অবকাশকে গলা টিপে মারেন। একমুঠো কাঁকর-ভর্তি চাল, একমুঠো কয়লার গুঁড়ো, এ যে আপনাদের কাছে সময়ের থেকে অনেক বেশী মূল্যবান।
না, এসব কথা বলেন না সেজদি।
তিনি শুধু হেসে বলেন, আপনাদের সংসার করা, আর আমার সংসার করা! কীই বা সংসার!
নিজের আর নিজের দিন নির্বাহের আয়োজনের সম্পর্কিত কথায় ভারী কুণ্ঠা সেজদির। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, কী রাঁধলেন? উত্তর দিতে সেজদি যেন লজ্জায় মরে যান। তাছাড়া রান্নার পদ সম্পর্কে বলতে গেলেই তো বিপদ। সেজদির অন্নপাত্রে একাধিক পদের আবির্ভাব দৈবাতের ঘটনা। শুধু যখন ছেলেরা কেউ ছুটিতে বেড়াতে আসে তখনই–
বাইরে থাকে ছেলেরা। ছুটি হলেই কলকাতা তাদের টানে। দুটি হলেই বৌ-ছেলে নিয়ে ট্রেনে চড়ে বসে মনকে বলে, চলো কলকাতা। অবশ্য এটা সম্ভব হয়েছে দুই ছেলেরই শ্বশুরবাড়ি কলকাতায় বলে। তা নইলে হয়তো বলতে হতো–চলো মধ্যপ্রদেশ, চলো উত্তরবঙ্গ।
স্বামীর ছুটির সুযোগে বৌদের গন্তব্যস্থল আর কোথায় হবে বাপের বাড়ি ছাড়া? আদিঅন্তকালই যে এই নিয়ম চলে আসছে, স্বয়ং মা দুর্গাই তার প্রমাণ। বৃন্তচ্যুত ফুলের মর্মকথা কারো জানা নেই, কিন্তু বৃন্তচ্যুত নারী-সমাজের মর্মকথা ধরা পড়ে তাদের এই পিত্ৰালয়প্রীতিতে।
থাকবেই তো প্রীতি।
শৈশবের সোনার দিনগুলি যেখানে ছড়িয়ে আছে স্মৃতির সুরভি হয়ে, কৈশোরের রঙিন দিনগুলি যেখানে বিকশিত হয়েছে, কম্পিত হয়েছে, আশা-আনন্দে দুলেছে, সেখানটার জন্যে মন ছুটবে না? যেখানে গিয়ে দাঁড়ালেই একান্ত প্রিয়জনের মুখ, সেখানে আকর্ষণ দুর্বার হবে না?
হয়।
তাই বৌরা স্বামীর ছুটি হলে বলে, ছুটিতে কাশ্মীরে বেড়াতে যাবার কথা বলছো, কিন্তু মা না অনেকদিন থেকে বলছেন–
ছেলেরা অতএব বাক্সবিছানা বেঁধে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে শিবঠাকুরের মতো গিরিবাজের গৃহেই এসে উদিত হয়। শ্বশুরের বাড়ি ছোট, ঘর কম, কি অন্য অসুবিধে, এসব চিন্তা বড় করে না। শুধু হয়তো ছুটির তিরিশ দিনের মধ্যে থেকে তিনদিন কেটে বার করে নিয়ে নিজের মায়ের কাছে ঘুরে আসে।
এটা অবশ্য শুধু অনামিকা দেবীর সেজদির ঘরেই ঘটছে তা নয়, ঘরে ঘরেই এই ঘটনা। মেয়েরা অনেক কিছু বোঝে, বোঝে না শুধু স্বামীরও হৃদয় নামক একটা বস্তু আছে।
প্রবাসে চলে গেলে পুরুষ বেচারীদেরও যে শৈশব-কল্যের সেই স্মৃতিময় ঘরখানির জন্য হৃদয়ের খানিকটা অংশে থাকে একটি গভীর শূন্যতা, তা মেয়েরা বুঝতে চায় না। পুরুষের আবার মন কেমন কি? তাই ওই তিনদিনের বরাদ্দে যদি আর দুটো দিন যোগ হয়ে যায়, বৌ অনায়াসেই ঝঙ্কার দিয়ে বলতে পারে, তুমি তো ছুটির সবটাই ওখানে গিয়ে কাটিয়ে এলে?
অনেক কিছু প্রোগ্রাম থাকে তাদের, তিরিশ দিনের ঠাসবুনুনি। সেই বুনুনি থেকে দুএকটা সুতো সরিয়ে নিলেও ফাঁকটা প্রকট হয়ে ওঠে।
সেজদির দুই বৌ দুধরনের, কিন্তু ছুটিতে বাপের বাড়ির ব্যাপারে প্রায় অভিন্ন। তবু বড় বৌ কদাচ কখনো চন্দননগরে অ্যাসে, ছোট বৌ কদাচ না।
ওরা এলে সেজদির সংসারটা সংসারের চেহারা নেয় দুতিন দিনের জন্যে।
তাছাড়া সারা বছর শুধু একটি অখণ্ড স্তব্ধতা।
পাড়ার মহিলারা দৈবাৎই আসেন, কারণ মোহনের মার সঙ্গে ওঁদের সুরে মেলে না। যেটুকু আসেন, নিতান্তই কৌতূহলের বশে। নিতান্তই সংবাদ সংগ্রহের আশায়, নচেৎ বলতে গেলে সেজদি তো জাতিচ্যুত।
গঙ্গাবক্ষে বাস করেও মোহনের মা নিত্য তো দূরের কথা, যোগেযাগেও গঙ্গাস্নান করেন না, পুজো করেন না, হিন্দু বিধবা-জনোচিত বহুবিধ আচারই মানেন না। এমন কি জানেনও না। বিধবাকে যে হরির শয়ন পড়ার পর পটল আর কলমি শাক খেতে নেই, একথা জানতেন না তিনি, তারকের মা সেটা উল্লেখ করায় হাসিমুখে বলেছিলেন, তাই বুঝি? কিন্তু হরির শয়নকালের সঙ্গে পটল-কলমির সম্পর্ক কি?
তারকের মা গালে হাত দিয়েছিলেন, ওমা শোনো কথা! বলি মোহনের মা, কোন বিলেতে মানুষ হয়েছিলে তুমি গো? শ্ৰীহরি যে কলমি শাকের বিছানায়, পটলের বালিশ মাথায় দিয়ে ঘুমোন, তাও জানো না? সেদিনকে-ইয়ে তোমার সেই অম্বুবাচীর দিনকের কথায় আমরা তো তাজ্জব! দত্তদিদি ফুলকুমারী আর আমি হেসে বাঁচি না। অম্বুবাচীতে বিধবাকে আগুন স্পর্শ করতে নেই শুনে তুমি আকাশ থেকে পড়লে!..যাই বলে ভাই, তোমার চোখ-কান বড় বন্ধ! ঘরে না হয় শাশুড়ী-ননদ ছিল না, পাড়াপাড়শীর সংসারও তো দেখে মানুষ!