- বইয়ের নামঃ বকুলকথা
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. মিছিল
ধ্বনিটা অতি–পরিচিত, শব্দগুলোও বহু–পরিচিত, চেয়ার থেকে উঠে জানলার ধারে না গেলেও বোঝা যেত কারা চলেছে মিছিল করে, আর কী বলে চলেছে তারা। মিছিল তো চন্দ্র–সূর্যের মতই নিত্য ঘটনা। কানের পর্দায় যেন লেগেই থাকে ধ্বনিটা—চলবে না! চলবে না! যেন অহরহই মস্তিষ্কের কোযে কোষে ধাক্কা মারে, মানতে হবে, মানতে হবে, আমাদের দাবী মানতে হবে।
তবু হাতের কলম নামিয়ে রেখে জানলায় এসে দাঁড়ালেন অনামিকা দেবী!
কিন্তু কেন দাঁড়ালেন?
মিছিলের ওই উচ্চরোলে লেখার ব্যাঘাত ঘটছিলো বলে? নাকি নেহাৎই অকারণ কৌতূহলে? হয়তো তাই। অকারণ কৌতূহলেই। শুধু জেনে নেওয়া, নতুন কোন অন্যায় বা অত্যাচারের বিরুদ্ধে আজকের এই প্রতিবাদ। নইলে রাস্তার গোলমালে লেখার ব্যাঘাত ঘটলে চলে না।
কলকাতা শহরের এমন একটি জনবহুল রাস্তার একেবারে মোড়ের ধারের বাড়িতে যাদের আজন্মের বাস, এই কোলাহলের মাঝখানে বসেই যার কলম ধরার শুরু, তার কি করে এ আবদার করা সম্ভব–নিঃশব্দে নির্জনতার গভীরে মগ্ন হয়ে লিখতে চাই আমি!
বিচিত্র শব্দ, বিরক্তিকর কোলাহল আর অগণিত মানুষের আনাগোনার মধ্যে থেকেই তো সাধনা করে যেতে হয় শহরে সাহিত্যিকদের। প্রতিক্ষণই করতে হয় প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম; কিন্তু একেবারে স্তব্ধ শান্ত স্তিমিত পল্পীজীবনের পরিবেশই কি সাধনার নিতান্ত অনুকূল? তেমন পরিবেশ পেলেই অনামিকা দেবী আরো অধিক লিখতে পারতেন? অধিকতর উচ্চমানের? অধিকতর মননশীল?
অপরাপর শহরবাসী কবি সাহিত্যিকরা কী বলেন, কী মনোভাব পোষণ করেন, অনামিকা দেবীর জানা নেই, মনের কথার আদান–প্ৰদান হবে এমন অস্তরঙ্গ তাই বা কার সঙ্গে আছে? তবে নিজে তিনি তা বলেন না। তা ভাবেন না।
তাঁর মনে হয়—শহরের মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তনশীল উত্তাল জীবনরসের মধ্যেই সাহিত্যের তীব্ৰ তপ্ত জীবনীরস। শহরের অফুরন্ত বৈচিত্র্যের মধ্যেই সাহিত্যের অফুরন্ত উপাদান।
নির্জনতার শাস্তিতে গতিবেগ কোথায়? শহরের নাড়ি সর্বদাই জ্বর–তপ্ত চঞ্চল। সেই জ্বর ছাড়াবার ওষুধ জানা নেই কারো, তবু একথা সবাই জানে ওই জুরাটাই প্রেরণা দিচ্ছে শিল্পকে, সাহিত্যকে, জীবন–চিস্তাকে। এই জুরাটাই বরং রোগীকে চাঙ্গা করে রেখেছে।
তাই কোলাহলকে কখনো বাধা স্বরূপ মনে হয় না। অনামিকা দেবীর। তিনি সর্বদা এই কথাই বলেন, আমি জনতার একজন। আমি জনতার সাহিত্যিক। কোলাহল থেকেই রস আহরণ করে নেওয়া আমার কাজ।
কিন্তু অনামিকা দেবীর সেই কবি সেজদি? তিনি কিন্তু অন্য কথা বলেন; তিনি বরং বলেন, ধন্যবাদ দিই তোকে। এই কলরবের মধ্যে লিখিস!
তা তিনি একথা বলবেন সেটাই স্বাভাবিক। অনামিকা দেবী যদি জনতার তো তিনি নির্জনতার।
তিনি কবি।
ইচ্ছের কবি।
তিনি তাঁর সেই মফঃস্বলের বাড়িটিতে নিঃসঙ্গতায় নিমগ্ন হয়ে বসে সেই ইচ্ছার ফুলগুলি ফোঁটান। সেইগুলিই হয়তো তার সঙ্গী।
অনামিকা দেবীর ভূমিকা আলাদা।
এ যুগের আরো সকলের মতই–অহরহ পরের ইচ্ছের বায়না মেটাতে হয় তাঁকে! পরের ইচ্ছেয় পরিচালিত হতে হয়।
মনের মধ্যে ওই মিছিলের ধ্বনি উঠলেও মেটাতে হয়।
জানলার ধারে এসে দাঁড়ালেন অনামিকা দেবী, নীচের দিকে তাকালেন, মানুষের প্রাচীর এগিয়ে চলেছে একটা অখণ্ড মূর্তিতে, আর যান্ত্রিক একটা শব্দ উঠছে তা থেকে চলবে না! চলবে না!
হঠাৎ অদ্ভুত একটা কৌতুক বোধ করলেন অনামিকা দেবী।
একদিক থেকে অবিরাম প্রতিবাদ উঠবে চলবে না চলবে না, আর একদিকে অব্যাহত গতিতে চলেই চলবে সেই অসহনীয়।
কোটি কল্পকালের পৃথিবীর বুকে কোটি কোটি বছর ধরেই চলেছে এই লীলা। পাশাপাশি চলেছে। অন্যায় আর তার প্রতিবাদ। আজকের মিছিলটা যে বিশেষ একটা কিছু তা বোঝা যাচ্ছে তার দৈর্ঘ্যে, শেষ হয়েও শেষ হচ্ছে না। একবার স্তিমিত হয়ে আসছে আওয়াজ, আবার পিছন থেকে আসছে নতুন আওয়াজের ঢেউ।
অবশেষে, অনেকক্ষণের পর হালকা হয়ে এল দল, ফিকে হয়ে এল ধ্বনি, যারা পিছিয়ে পড়েছিল তারা ছুটে ছুটে আসছে, তাদের ফাঁকে ফাঁকে অন্য অন্য পথচারীর চেহারা দেখা যাচ্ছে।
দূরে এগিয়ে যাওয়া আওয়াজটা নিয়মমাফিক কমে কমে আসছে।
জানলা থেকে আবার ফিরে এলেন অনামিকা দেবী। চেয়ারে এসে বসলেন, কলামটা হাতে তুলে নিলেন। কিন্তু চট করে যেন মনে এল না কি লিখছিলেন? অন্যমনস্কের মত সম্পূর্ণ অবান্তর একটা কথা মনে এল। লেখার কথা নয়, ওই মিছিলের কথা নয়, দেশের বহুবিধ অন্যায় অনাচার দুর্নীতি আর রাজনীতির কথাও নয়, মনে এল। এই বাড়িটা যখন তৈরী হয়েছিল তখন এপাশে–ওপাশে ফাঁকা ফাকা মাঠ পড়ে ছিল।
এখন সমস্ত রাস্তাটা যেন দম আটকে দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু বাড়িটা কি আজ তৈরী হয়েছে? কত দিন মাস বছর পর হয়ে গেল তার হিসেব করতে হলে বুঝি খাতা পেনসিল নিয়ে বসলে ভাল হয়।
অনামিকা দেবী ভাবলেন, আমি এর শৈশব বাল্য যৌবন আর এই প্রৌঢ়াবস্থা সব অবস্থার সাক্ষী। অথবা এই বাড়িটাই আমার সমস্ত দিন মাস বছরের সাক্ষী। এর দেওয়ালে দেওয়ালে লেবা আছে আমার সব কথা।
আচ্ছা, দেওয়াল কি সত্যি সাক্ষ্য দিতে পারে? সে কি সব কথা ধরে রাখতে পারে অদৃশ্য কোনো অক্ষরে? বিজ্ঞান এত করছে, এটা করতে পারে না কোনো দিন? মৌন মূক দেওয়ালগুলোকে কথা কইয়ে ইতিহাসকে পুরে ফেলবে হাতের মুঠোয়! নির্ভুল ইতিহাস!