সত্যবতী গুটি গুটি এগিয়ে একবার পিসীর উঠোনের ভিতর গিয়ে দাঁড়ায়, এদিক ওদিক তাকিয়ে নেড় পুণ্য কারও দেখা না পেয়ে ফিরে এসে ম্লান মুখে বললে, ওদের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না!
কেন, গেল কোথায় সব?
কি জানি! সত্য আস্তে আস্তে সাহসে ভর করে প্রাণের কথাটা বলে ফেলে, বাবা, তুমি তো মারা বাঁচাতে পার!
মরা বাঁচাতে? দূর পাগলী!
সত্য মিয়মাণ ভাবে বলে, তবে যে লোকে বলে!
লোকে বলে? কি বলে? অন্যমনস্ক ভাবে মেয়ের কথার জবাব দিয়ে রামকালী এদিক ওদিক তাকাতে থাকেন, যদি একটা বেটা ছেলের মুখ চোখে পড়ে। এসে যখন পড়েছেন তিনি, দায়িত্ব এড়িয়ে চলে যেতে তো পারেন না। জটাদের তেমন বাঁশঝাড় না থাক, রামকালীর বাগান থেকেই বাঁশ কেটে আনতে হুকুম দেবেন। কিন্তু কই? কে কোথায়? বাড়ির ভিতর থেকে সুর উঠছে নানা রকম, বাইরেটা শূন্য স্তব্ধ!
ভালর মধ্যে আকাশটায় হঠাৎ মেঘ উড়ে গিয়ে দিব্যি পরিষ্কার হয়ে উঠেছে, আর বোঝা যাচ্ছে সন্ধ্যার এখনো দেরি আছে।
হঠাৎ সত্যবতী একটা অসমসাহসিক কাণ্ড করে বসে, বাপের একখানা হাত দু হাতে চেপে ধরে রুদ্ধকণ্ঠে বলে ওঠে, বলে যে কবরেজ মশাই মরা বাঁচাতে পারেন! দাও না বাবা একটুখানি ওষুধ জটাদার বৌকে!
রামকালী এই অবোধ বিশ্বাসের সামনে থতমত খেয়ে সহসা কেমন অসহায় অনুভব করেন। তাই ধমকে ওঠার পরিবর্তে মাথা নেড়ে বলেন, ভুল বলে মা! কিছুই পারি নে! মিথ্যে অহঙ্কারে কতকগুলো শেকড়-বাকড় নিয়ে নাড়ি আর লোক ঠকাই!
সত্যবতী এ কথার সুর ধরতে পারল না, পারার কথাও নয়, বুঝল এ হচ্ছে বাবার রাগের কথা। কিন্তু আপাতত সে মরীয়া। যা থাকে কপালে, বাবার হাতে যদি ঠেঙানি খাওয়া থাকে তাই খাবে সত্য, কিন্তু সত্যবতীর চেষ্টায় জটাদার বেঁটা যদি বাঁচে! তাই চোখ-কান বুজে সে বাবার গায়ের চাদরের খুঁটটা টেনে বলে ফেলে, তোমার পায়ে পড়ি বাবা, জন্মের শোধ একটু ওষুধ দাও না। আহা, বিনি চিকিচ্ছেয় মারা যাবে জটাদার বৌ!
মরার পর যে আর চিকিচ্ছে চলে না, এ কথা আর মেয়ের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারলেন না রামকালী। শুধু একটা নিঃশ্বাস ফেলে ফের ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, চল দেখি।
জমজমাট নাটকের মধ্যখানে যেন হঠাৎ আসরের চাঁদোয়া ছিঁড়ে পড়ল। কবরেজ মশাইয়ের গলা-খাঁকারি না?
হ্যাঁ, তাই বটে। বিশালকার সুকান্তি পুরুষ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। সঙ্গে সঙ্গে সত্যর শানানো গলা বেজে উঠেছে, বাবা বলছেন, ভিড় ছাড়তে হবে!
পাড়ার মহিলারা মাথায় কাপড় টেনে চুপ করে গেলেন। শুধু জটা-জননী ড়ুকরে উঠলেন, ও মেজদা গো, আমার জটা আজ লক্ষ্মীছাড়া হল গো!
থাম। যেন একটা বাঘ হুঙ্কার দিল, তোর জটা আবার লক্ষ্মীছাড়া না ছিল কবে? একেবারে শেষ করে ফেলেছে তো?
ভির সরে গেছে, কবরেজ মশাই ভাগ্নে-বৌয়ের কাছে গিয়েও যতটা সম্ভব ছোঁয়া বাঁচিয়ে হেঁট হয়ে দু আঙুলে নাড়িটা টিপে ধরেন, আর মুহূর্তকাল পরেই চমকে ওঠেন।
যাক, সব রং-তামাশা ফক্কিকার!
শুধু নাটকের একটা দৃশ্যই জখম নয়, আগাগোড়া নাটকটাই খতম! বেহব্বারম্ভে লঘূক্রিয়ার এহেন উদাহরণ আর কখনও কেউ দেখেছে না। শুনেছে? জটার বৌয়ের এই আচরণটা যেন ধাষ্টামোর চরম, ক্ষমার অযোগ্য! ছি:। ছি, মেয়েমানুষের প্রাণ বলে কি এমনই কাঠ-পরমায়ূ হতে হয় গো? তবে এ মেয়েমানুষের কপালে যে অশেষ দুঃখ তোলা আছে, তাতে আর কারও মতভেদ থাকে না। মরে গিয়ে তুলসীতলায় শুয়ে আবার চারদণ্ড পরে ঘরে উঠে শোয়, ঢাক ঢকা করে একবাটি গরম দুধ গেলে, এমন মেয়েমানুষের খবর এর আগে এরা অন্তত কেউ পান নি!
ছি ছি, কী ঘেন্না! পুরুষের প্রাণ হলে আর এই স্বর্ণসিঁদুরটুকু জিভে ঠেকিয়েই চোখ খুলতে হত না! কিন্তু যাই বল, জটার বৌ। খুব খেল দেখালো বটে! … এইবার শাশুড়ী মাগীর হাতে যা খোয়ার হবে টের পাচ্ছি, মাগীর যা অপমান্যি হয়েছে আজ! … কিন্তু যাই বলো, তুলসীতলা থেকে অমন হুট্ করে ঘরে তোলাটা ঠিক হয় নি, একটা অঙ্গ-প্ৰচিত্তির-টাচিত্তির করা কোর্তব্য ছিল।
কে জানে বাবা, সত্যি বেঁচে ছিল না কোন অবদেবতায় ভর করল! আমার তো কেমন সন্দ হচ্ছে! থাম সেজবৌ, সাঁজসন্ধ্যোয় একা ঘাটে-পথে যাই, ভাবলে গা ছম্ ছম্ করবে। কিন্তু ছাউনিটা একটু কেমন কেমনই লাগিল! না না, ওসব কিছু না, কবরেজ মশাই তো বললেনই, আচমকা ধাক্কা খেয়ে ভির্মি গেছল!
নে বাবা চল চল, ছিষ্টি সংসারের কাজ পড়ে, নাহক পাঁচ দণ্ড সময় বৃথা নষ্ট হল। জটার মান আদিখ্যেতাটা দেখলি? যেন বৌ মরে বুক একেবারে ফেটে যাচ্ছিল! … দেখেছি। দেখতে আর বাকী কিছুই নেই। বুক যদি ফেটেছে, বৌ জীইয়ে ওঠায়! বড় আশায় ছাই পড়ল। ভাবছিল তো বেট তার ভাগ্যিমান হল। আবার এখুনি তার বে দিয়ে, দানসামগ্ৰী গয়নাপত্তর ঘরে তুলবে!
বাক্যের স্রোত আর থামে না।
ঘাটে পথে, আপনি বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে বাক্যের বৃন্দাবন বসে যায়। এত বড় একটা ঘটনাকে এ॥৩ সহজে জুড়িয়ে ফেলতে ইচ্ছে কারুরই ইচ্ছে না; জটার মাকে পেড়ে ফেলবার এত বড় সুবর্ণ সুযোগটাও মাঠে মারা গেল। জটার বৌয়ের উপর কিছুতেই আর প্রসন্ন হতে পারছেন না কেউ, ধৌটা যেন সবাইকে বড় রকমের একটা ঠকিয়েছে। জ্ঞাতি খুড়শাশুড়ী খবর পেয়েই আঁচলের তলায় লুকিয়ে আলতাপাতা আর সিঁদুরগোলা এনেছিলেন, যাতে প্রথম সিঁদুর দেওয়ার বাহাদুরিটা তারই হয়। সেগুলো এখন ঘাটে ভাসিয়ে এলেন। যতই হোক, মড়ার জন্যে আনা তো! তা রাগটা তারই বেশী হচ্ছে জটার বউয়ের ওপর!