আবার রায়পাড়াও গিছিলি! নাঃ, বিপদ করলে দেখছি। জটার বৌয়ের আবার হঠাৎ কি হল যে নাড়ী ছেড়ে যাচ্ছে?
যাচ্ছে কি বাবা, সত্য আরও উৎসাহ সহকারে বলে, গেছে। সেজপিসী চোঁচাচ্ছে, বুক চাপড়াচ্ছে আর বালিশ বিছানা সরিয়ে নিচ্ছে।
আঃ কি যে বলে! চল দেখি গে। রামকালী বলেন, ঝড় উঠে পড়ল, এখুনি বিষ্টি আসবে, কি মুশকিল! হয়েছিল কি?
কিছু নয়। সেজপিসী বললে, রান্নাবান্না সেরে যেই খেতে বসেছে জটাদার বৌ, আর আমনি ওটাদা পান চেয়েছে! জটাদার বৌ বলেছে, পান ফুরিয়ে গেছে, ব্যস বাবু মহারাজের রাগ হয়ে গেছে। দিয়েছেন ঠাঁই ঠাঁই করে পিঠের ওপর লাথি। আর অমনি জটা-বৌঠান কাসিতে মুখ থুবড়ে। হঠাৎ খুক খুক করে হেসে ওঠে সত্যবতী।
হাসছিস যে!
ধমকে উঠলেন রামকালী। বিরক্ত হলেন। কী অসভ্য হচ্ছে মেয়েটা! হাসির কি সময় অসময় নেই? বললেন, মানুষ মরছে দেখে হাসতে হয়? এই শিক্ষাদীক্ষা হচ্ছে?
সত্যবতী নিতান্তই হেসে ফেলেছিল, এখন বাপের ধমকে সামলে নিয়ে মুখটা স্নান করবার চেষ্টা করে বলে, সেজপিসী বলছিল যেই না ধাক্কা খাওয়া আমনি কুমড়ো গড়াগড়ি হয়ে দাওয়া থেকে উঠোনে পড়ে গেল! কষ্টে হাসি চেপে ফের বলে সত্যবতী, জটাদার বৌ অনেক ভাত খায় না বাবা! তাই অত মোটা!
আঃ! বলে বিরক্তি প্ৰকাশ করে তাড়াতাড়ি এগোতে থাকেন। রামকালী।
সত্যবতীও হাঁটায় কিছ কম দাঁড় নয়। বাপের সঙ্গে সমানই এগোতে থাকে।
রামকালী জটার বৌয়ের জন্য সহানুভূতিতে যতটা না হোক, জটার ব্যবহারে মনে মনে অত্যন্ত বিরক্তি বোধ করেন। হতভাগা বামুনের ঘরের গরু, পেটে ক অক্ষরের আঁচড় নেই, গাজা-গুলি সবেতেই ওস্তাদ। আবার বংশছাড়া বিদ্যে হয়েছে, বৌ-ঠেঙানো! জটা, ফাটর বাপ তো আমন ছিল না! বরং রামকালীর গুণবতী বোনই লোকটাকে সারাজীবন জুলিয়ে পুড়িয়ে খেয়েছেন!
কে জানে কী কী ভাবে বেটক্করে লেগেছে, সত্যিই যদি মরে-টারে যায়, দস্তুরমত ফ্যাসাদে পড়তে হবে।
সত্যবতীর কথা ভুলে গিয়ে আরও জোরে পা চালান রামকালী। সত্যবতী এবার দৌড়তে শুরু করে। হেরে যাবে না। সে।
চোখ কপালে উঠে স্থির হয়ে গেছে, মুখে ফেনা ভেঙ্গে সে ফেনা শুকিয়ে উঠেছে। হাত পা ঠাণ্ডা পাথর।
সন্দেহ আর নেই, সমস্ত লক্ষণই স্পষ্ট। তুলসীতলায় শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই। অবশ্য কষ্ট করে আর ঘর থেকে বয়ে আনতে হয় নি, লাথি খেয়ে গড়িয়ে তো উঠোনেই পড়েছিল তুলসীতলার কাছবরাবর। দণ্ডখানেকের মধ্যেই বেতারবার্তায় সারা পাড়ায় সংবাদ রটে গেছে এবং পাড়া ঝেটিয়ে মহিলাবৃন্দ এসে জড়ো হয়েছেন, আসন্ন ঝড়ের আশঙ্কা তুচ্ছ করে।
ব্যাপারটা তো কম রংদার নয়, দৈনন্দিন বৈচিত্ৰ্যশূন্য জীবননাট্যের মধ্যে এমন একটা জোরালো দৃশ্য দর্শনের সৌভাগ্য জীবনে কবার আসে?
প্ৰথমে সমস্ত জনতার মধ্যে উঠল একটা চাপা উত্তেজনার আলোড়ন, জটা নাকি বৌটাকে একেবারে শেষ করে ফেলেছে! তারপর হায় হায়। জটা সম্পর্কে মন্তব্যগুলিও এখন আর জটার মার কান বাঁচিয়ে হচ্ছে না। কারণ স্পষ্ট কথা বলে নেবার মত এ-হেন সুযোগই বা কার জীবনে কবার আসে?
সত্যি শেষ হয়ে গেছে? ছিছিছি, কী খুনে দস্যি ছেলে গো! ধন্যি সন্তান পেটে ধরেছিল ম্যাগী! আচ্ছা জটাটাই বা এত গোয়ার হল কোথা থেকে? ওদের বাপ তো ভালমানুষ ছিল! হল কোত্থেকে? তুমি আর জ্বলিও না ঠাকুরঝি, বলি গৰ্ভধারিণীটি কেমন? এ হচ্ছে খোলের গুণ!. আহা হাবাগোবা নিপাট ভাল মানুষ বেঁটা, মা-বাপের বাছা, বেঘোরে প্রাণটা গেল! এমনি নানাবিধ আলোচনা চলতে থাকে। একটা মেয়েমানুষের জন্যে, এর চাইতে আর কত বেশী দরদ আশা করা যায়?
প্রতিবেশিনীদের আক্ষেপোক্তিগুলো নীরবে হজম করতে বাধ্য হচ্ছিলেন জটার মা, কারণ আজ তিনি বড় বেকায়দায় পড়ে গেছেন। তাই সমস্ত মন্তব্য চাপা পড়ে যায় এমন সুরে মড়াকান্নাটা জুড়ে দেন তিনি, বুক চাপড়ে চাপড়ে মৰ্মভেদী হৃদয়বিদারক ভাষায় ইনিয়ে বিনিয়ে।
বাড়ির কাছাকাছি আসতে না আসতেই শুনতেই পেলেন রামকালী খুড়তুতো ছোটবোনের সেই পাজারভাঙা শোকগাথা, ওরে আমার ঘরের লক্ষ্মী ঘর ছেড়ে আজ কোথায় গেল রে! ওরে সোনার পিতিমেকে বিসর্জন দিয়ে আমি কোন প্ৰাণে ফের সংসার করব রে! ওরে জটা, তোর যে নগরে না। উঠতেই বাজারে আগুন লাগল রে!
সত্যবতী বলে উঠল, যাঃ, সৰ্বনাশ হয়ে গেল!
দ্রুত পদক্ষেপটা হঠাৎ স্তিমিত হল, ভুরুটা একবার কুঁচকোলেন রামকালী। যাক তা হলে হয়েই গেছে! তবে আর তিনি গিয়ে কি করবেন? এখন জটা হতভাগার কপালে কত দুৰ্গতি আছে, কে জানে!
হঠাৎ ভয়ানক রকমের একটা চিৎকার উঠল, বোধ করি ফিনিশিং টাচ্। ওরে বাবা রে, আমার কী সর্বনাশ হল রে! কী রাঙের রাঙা বৌ এনেছিলাম রে!
রামকালী পায়ে পায়ে এগোতে এগোতে সহসা দরজার কাছাকাছি এসেই ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, যাক, সত্যিই শেষ হয়ে গেছে তা হলে! সত্য তুই বাড়ি যা।
সত্যবতী কাঠ!
বাড়ি! একলা?
কেন একলা কেন, নেড়ু আর পুণ্য এসেছিল বললি না?
সত্যবতী ভয়ে ভয়ে বলে, এসেছিল তো, আর কি এখন যাবে তারা?
যাবে না? যাবে না। মানে? ওদের ঘাড় যাবে! দেখ কোথায় আছে। আমাকে তো আবার এদের এদিক দেখতে হবে।
কৈফিয়ত দিয়ে কথা রামকালী কদাচ কাউকে বলেন না, কিন্তু সত্যর কাছে সামান্য একটু সহজ রামকালী।