পালকিটি ধার দিয়ে আসতে হয়েছে রায়পাড়ায়।
গ্রাম-বৃদ্ধ রায়মহাশয়ের অবস্থা খারাপ, খবর পেতে নাড়ী দেখতে গিয়েছিলেন রামকালী। নাড়ীর অবস্থা দেখে গঙ্গাযাত্রার ব্যবস্থা দিলেন, আর ব্যবস্থা দিয়েই পড়লেন বিপাকে।
রায়মশায়ের ছেলেরা দুজনেই গত হয়েছে, আছে তিন নাতি কিন্তু তাদের এমন সঙ্গতি নেই যে পালকিভাড়া দিয়ে আর চারটে বেহারাকে মজুরি জলপানি দিয়ে ঠাকুরদার গঙ্গাযাত্রা করাবে। অথচ আমন নিষ্ঠাবান সদাচারী প্রাচীন মানুষটা ঘরে পড়ে মরবে? এটাই বা চোখে দেখে সহ্য করা যায় কি করে? আর গেলে ত্ৰিবেণীর গঙ্গাই উত্তম। গঙ্গাযাত্রার ঘোষণা শুনেই রায়মশাইয়ের নাতিরা যেই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল, সঙ্গে সঙ্গেই বলতে হল রামকালীকে, পালকির জন্যে চিন্তা করো না, আমার পালকিতেই যাবেন রায় কাকা।
নাতিরা অস্ফুটে একবার বলল, আপনাকে রোগী দেখতে দূরে দূরে যেতে হয়, পালকিটা দিলে–
রামকালী গম্ভীর হাস্যে বললেন, তবে নয়। ঠাকুরদাকে কাঁধে করেই নিয়ে যাও! তিন নাতি রয়েচ উপর্যুক্ত!
বয়োজ্যেষ্ঠর পরিহাসবাক্যে হেসে ফেলবে এমন বেয়াদপির কথা অবশ্য ভাবাই যায় না, কাজেকাজেই তিনজনে ঘাড় চুলকোতে লাগল। আর ওরই মধ্যে যে বড়, সে সাহসে ভর করে বলল, ভাবছিলাম গো-গাড়ি করে—
ভাবাটা খুব উচিত হয় নি বাপু! রামকালী বলেন, গো-বাড়ি চড়িয়ে নিয়ে গেলে ওই বিরোনব্বই বছরের জীর্ণ খাঁচাখানা কি আর প্রাণপাখি সমেত গঙ্গা পর্যন্ত পৌঁছবে? পাখি খাঁচাছাড়া হয়ে উড়ে যাবে। আমিও ওঁর সন্তানতুল্য বাপু, তোমাদের সঙ্কোচ করবার কিছু নেই। তাছাড়া চটপট ব্যবস্থার দরকার, কখন কি হয় বলা যায় না।
রায়মশাইয়ের ঘোলাটে চোখ দুটো থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। তিনি শিরাবহুল ডানহাতখানা আশীর্বাদের ভঙ্গীতে তুলে বললেন, জয়স্তু।
বাইরে এসে রামকালী পালকিবোহারা কটাকে নির্দেশ দিলেন, পালকিটা আর মিথ্যে বয়ে নিয়ে যাবি কেন, ওটা এখানেই থাক, তোরা বাড়ি গিয়ে খেয়ে-দোয়ে নে গে। শেষ রাতে উঠে চলে আসবি। আর দেখ, বাড়ি থেকে কালকের সারাদিনের মতন জলপান নিয়ে আসবি, বুঝলি? আর শোন, তোরা এখন এখানে কিছু কাজকর্মের প্রয়োজন আছে কিনা দেখ। আমি বাড়ি ফিরছি।
জোর পায়েই ফিরছিলেন রামকালী, কারণ বেরিয়েই দেখেছিলেন ঈষাণ কোণে মেঘ। পালকি চড়ে রুগী দেখতে যান বলে যে রামকালী হাঁটতে অনভ্যস্ত তা নয়। প্রতিদিন ব্ৰাহ্মমুহূর্তে উঠে, প্রাতঃকৃত্য সেরে ক্রোশ-দুই হেঁটে আসা তাঁর নিত্যকর্মের প্রথম কর্ম। তবে হ্যাঁ, রোগীর বাড়ি যাওয়ার কথা আলাদা, সেখানে মান-মর্যাদার প্রশ্ন।
পথ সংক্ষেপের জন্য বাগানের পথ ধরেছিলেন, কিন্তু আমবাগানের কাছবরাবর আসতেই ঝরাপাতা আর ধুলোর ঝড় উঠল। রামকালী তাড়াতাড়ি বাগানের মাঝামাঝি থেকে বেরিয়ে কিনারায় এলেন, আর আসতে না আসতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। গলা কার?
সত্যর না?
হ্যাঁ, সত্যরই তো মনে হচ্ছে।
যদিও ঝড়ের সোঁ সোঁ শব্দের বিপরীতে শব্দটা হওয়ায় বুঝতে সামান্য সময় লেগেছিল, কিন্তু সে সামান্যই। তা ছাড়া গরু দুটোর নামও পরিচিত। শ্যামলী ধবলী রামকালীর বাড়িরই গরু। গরু অবিশ্যি চাটুয্যেদের একগোহাল আছে, কিন্তু এই গরু দুটি বিশেষ সুলক্ষণযুক্ত বলে রামকালীর বড়ই প্রিয়। সময় পেলেই রামকালী নিজে হাতে ওদের মুখে ঘাস ধরে দেন, গায়ে হাত বুলেন। বাড়ির কুমারী মেয়েরা শ্যামলী ধবলীকে নিয়েই গোকাল ব্ৰত করে, মোক্ষদা তাদের কাছ থেকে সংগৃহীত গোময় দ্বারাই সম্যক বিশুদ্ধতা রক্ষা করে চলেন।
কান খাঁড়া করে ধ্বনির মূল উৎসের দিকটা অনুমান করে নিলেন রামকালী, তারপর দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়ে ধরে ফেললেন কন্যাকে। সত্যবতী তখন ধুলোর আচোট থেকে চোখ রক্ষা করতে আঁচলের কোণটা দুহাতে মুখের সামনে তুলে ধরে ছুটছিল।
যাচ্ছিস কোথায়?
জলদগম্ভীর স্বরে হাঁক দিলেন রামকালী।
সত্যবতী চমকে মুখের ঢাকা খুলে থ!
যদিও সকলেই সত্যবতীকে বাপ-সোহাগী আখ্যা দেয় এবং সত্যিই সত্যবতী রামকালীর বিশেষ আদরিণী,–তা ছাড়া পয়মন্ত মেয়ে বলে রামকালী মনে মনে বেশ একটু সমীহও করেন। তাকে, তাই বলে সামনাসামনি যে কোন আদর-আদিখ্যেতার পাট আছে তা নয়। কাজেই বাবার গলা শুনেই সত্যবতীর হয়ে গেছে!
রামকালী আর একবার প্রশ্ন করেন, এমন সময়ে একা গিয়েছিলি কোথায়?
সত্যবতী ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, সেজপিসীর বাড়ি।
সত্যবতী যাকে সেজপিসী আখ্যা দিল তিনি হচ্ছেন রামকালীর খুড়তুতো বোন, এ গ্রামেই শ্বশুরবাড়ি। এ গ্রামেই বাস।
রামকালী ভুরু কুঁচকে বলেন, অত দূরে আবার একা একা যাবার দরকার কি? সঙ্গে কেউ নেই কেন?
এইজন্যেই সত্যবতীর বাপসোহাগী আখ্যা।
চড় নয়, চাপড় নয়, নিদেন একটা কানমলাও নয়। শুধু একটু কৈফিয়ত তলব।
সত্যবতী এবার সাহস পেয়ে বলে, না একা কেন, পুণ্যপিসি আর নেড়ু ছিল। তারপর আমি তোমাকে ডাকতে ছুটতে ছুটতে আসছি।
আমাকে ডাকতে ছুটতে ছুটতে আসছিস? রামকালী ভুরু কুঁচকে বলেন, কেন? আমায় কি দরকার?
সত্যবতী এবার পূর্ণ সাহসে ভর করে সোৎসাহে বলে, জটাদার বৌ যে মর-মার। নাড়ী ছেড়ে গেছে। তাই সেজপিসী কেঁদে বললে, যা সত্য, একবার মেজদাকে ডেকে নিয়ে আয়, যেখানে পাস। তা আমি রায়পাড়া গিয়ে শুনলাম তুমি এই মাত্তর চলে এসেছ!