হঠাৎ হি-হি করে হেসে ওঠে সত্যবতী, হেসে বলে, লোকে বললেই বা! বললে কি তোমার গায়ে ফোস্কা পড়বে!
মোক্ষদা নেহাৎ মেয়েটাকে ছুতে পারবেন না, তাই নিজের গালেই একটা চড় মেরে বলেন, শুনলে নতুন মেজবৌ, তোমার নাতনীর আস্পদ্দার কথা? বলে কি না লোকে বললেই ব! ডাক শাস্তরের কথা, যাকে বললো ছি, তার রইলো কি? আর বলে কি না—
সেরেছে!
দীনতারিণী ভাবেন মোক্ষদা একবার মুখ ধরলে তো আর রক্ষে নেই! দুৰ্দান্ত স্বাস্থ্য মোক্ষদার, দুরন্ত ক্ষিদে-তেষ্টা, সেই ক্ষিদে-তেষ্টা চেপে রেখে তিন পহর বেলায় জল খায়, বেলা গড়িয়ে অপরাহ্ন বেলায় ভাত, সকালের দিকে শরীরের মধ্যে ওর খা খা বা ঝা করতে থাকে। তাই কথার চোটে থরহরি করে ছাড়ে সবাইকে।
প্ৰসঙ্গটা তাই তাড়াতাড়ি পরিবর্তন করেন দীনতারিণী, হ্যাঁ লা সত্য, সকালবেলা জলপান খাস নি? অসময়ে এখন পান্তাপাতের খোঁজ?
আহা কী বুদ্ধির ছিরি! সত্য ঝেজে ওঠে, আমি যেন খাবো! কেঁচো আর পান্তাভাত দিয়ে টোপ ফেলবো!
কি করবি? দীনতারিণীর আগেই মোক্ষদা দুই চোখ কপালে তোলেন, কি করবি?
টোপ ফেলবো, টোপা! মাছের টোপ! পেয়েছ। শুনতে? নেড় আমায় কঞ্চি চেঁচে খু-ব ভালো একটা ছিপ করে দিয়েছে, খিড়কির পুকুরে মাছ ধরবো।
সত্য! মোক্ষদা যেন ছিটাপিটিয়ে ওঠেন, ছিপ ফেলে মাছ ধরবি তুই? খুব নয় বোপসোহাগী আছিস, তাই বলে কি সাপের পাঁচপা দেখেছিস? মেয়ে ছিপ ফেলে মাছ ধরবি?
সত্য ঝাঁকড়া চুলে মাথা ঝাকিয়ে বলে, আহা! র কী বাক্যির ছিরি! মেয়েমানুষ মাছ ধরে না? রাঙা খুড়িমারা ধরে না? ও বাড়ির পিসিরা ধরে না?
আ মরণ মুখপোড়া মেয়ে! ওরা ছিপ ফেলে মাছ ধরে? ওরা তো গামছা ছাকা দিয়ে চুনোপুটি তোলে!
তাতে কি! সত্য হাতের মানপাতাখানা দাওয়ার গায়ে আছড়াতে বলে, গামছা দিয়ে ধরলে দোষ হয় না, ছিপ দিয়ে ধরলেই দোষ! চুনোপুটি ধরলে দোষ হয় না, বড় মাছ ধরলেই দোষ! তোমাদের এসব শাস্তর কে লিখেছে। গা?
সত্য! দীনতারিণী কড়াস্বরে বলেন, একফোঁটা মেয়ে, অত বাক্যি কেন লা? ঠিক বলেছে ছোটঠাকুরঝি, পরের ঘরে গিয়ে হাড়ির হাল হবে এর পর!
বাবা বাবা! দুটো পান্ত চাইতে এসে কী খোয়ার! যাচ্ছি। আমি আঁশ হেঁসেলের ওদের কাছে। যাবো কি? সেখানে তো আবার বড় জেঠি! গুলি ভাটার মতন চাউনি! খেঁদিদের বাড়ি থেকে নিলেই হত তার চেয়ে!
কি বললি! খেঁদিদের বাড়ি থেকে ভাত? কায়েত-বাড়ির ভাত নিয়ে ঘাঁটবি তুই?
ঘেঁটেছি নাকি? বাবাঃ বাবাঃ! ফি হাত তোমাদের খালি দোষ আর দোষ! আচ্ছা যাচ্ছি। আমি ও হেঁসেলেই। কিন্তু যখন ইয়াবড় মাছ ধরবো। তখন দেখো।
বলে সত্য আছড়ানোর চোটে চিরে চিরে যাওয়া মানপাতাটা হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে যায় দাওয়ার কোণ-বরাবর ধরে ও মহলে।
সেখানে বিরাট এক কর্মকাণ্ড চলেছে অহরহ। দিনে দুবেলায় দুশো আড়াইশো পাত পরে।
সেখানেও এমনিই উঁচু পোতার রান্নাঘর, তবে দাওয়ায় উঠতে তেমন বাধা নেই। বেপরোয়া উঠে গেল। সত্য। আর এদিক ওদিক তাকিয়ে দাওয়ার কোণ থেকে একখানা খালি নারকেলের মালা কুড়িয়ে নিয়ে রন্ধনশালার দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে সাহসে ভর করে ডাকলো, বড় জেঠি!
০৪. সারাদিন গুমোটের পর
সারাদিন গুমোটের পর হঠাৎ একচিলতে ঠাণ্ডা হাওয়া উঠল। গা জুড়িয়ে এল, কিন্তু প্ৰাণে জাগছে আতঙ্ক। সময়টা খারাপ, চৈত্রের শেষ। ঈষাণকোণে মেঘ জমেছে, তার কালো ছায়া আধখানা আকাশকে যেন ঘোমটা পরিয়ে দিল। যেন একটা দুরন্ত দৈত্য হঠাৎ পৃথিবীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বার আগের মুহূর্তে পায়তাড়া কষছে।
মাঠের ঘাটে পথে পুকুরের যে যেখানে বাইরে ছিল, তারা ঘন ঘন আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে হাতের কাজ চটপট সারাতে শুরু করল।
আর বাতাসে বাতাসে তরঙ্গ তুলে গ্রামের এ-প্ৰান্ত থেকে ও-প্রান্ত অবধি ছড়িয়ে পড়ল একটানা একটা সানুনাসিক স্বরের ধুয়ো। সে স্বর ধাপে ধাপে চড়ছে, মাঝে মাঝে খাদে নামছে। তার ভাষাটা এই বুধী আঁ-য়! সুন্দরী আঁ-য়! মুংলী আঁ-য়! লক্ষ্মী আঁয়!
ঝড়ের আশঙ্কায় গৃহপালিত অবোলা জীবগুলিকে গোচারণ ভূমি থেকে গোহালে ফেরার আহবান জানানো হচ্ছে।
সত্যবতী জানে না। ঝড়ের আগের মুহূর্তে কিংবা সন্ধ্যার আগে গরুগুলোকে যখন ডাক দেওয়া হয়, তখন নাকি সুরে ডাকা হয় কেন ও জানে এই নিয়ম। অবিশ্যি যারা ডাকে, তারা নিজেরাই বা আট বছরের সত্যবতীর চাইতে ৰোশী কি জানে? তারাও জ্ঞানাবধি দেখে আসছে। গরুকে সাবসন্ধ্যায় ঘরে ফিরিয়ে আনবার সময় আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে যে আহবানটা জানানো হয়, সেটার সুর সানুনাসিক। কে জানে কোন কালে কোন বেরপ্রাপ্ত গরু মানুষের ভাষা শিখে ফেলে, মানুষের কাছে তার পছন্দ-অপছন্দর নমুনাটা জানিয়েছে কিনা। বলেছে কিনা। এই সানুনাসিক স্বরটাই আমার রত চিকর।
আপাতত দেখা যাচ্ছে এই অবোলা জীবগুলি এ-প্ৰান্ত ও-প্রান্ত ধুয়োতে সচকিত হয়ে দ্রুতগতিতে গোহালিমুখী হচ্ছে। তারাও গলা তুলে আকাশটাকে দেখে নিচ্ছে একবার একবার।
সত্যবতী একটা সংবাদ বহন করে দ্রুতগতিতে বাঁড়ুয্যে-পাড়া থেকে বাড়ির দিকে আসছিল, তবু আশেপাশে ধুয়ো শুনে অভ্যাসবশে গলার সুর চড়িয়ে হাঁক পাড়ল, শ্যামলী আঁ-য়! ধবলী আঁ-য়!
আমবাগানের ওদিক দিয়ে রামকালী ফিরছিলেন রায়পাড়া থেকে পায়ে হেঁটে।