রান্নার দায়িত্ব দীনতারিণীর, মোক্ষদার ওপর সে রান্নার বিশুদ্ধতা রক্ষার দায়িত্ব। বাকি দুজন যোগাড়ে। তা অবিশ্যি যোগাড়ের কাজটাও কম না। প্রয়োজনটা চারজনের হলেও আয়োজনটা অন্তত দশজনের মত হয়।
কিন্তু এসব কথা থাক।
আসলে ছেলে।পুলের এ উঠোনে পা দেবারও হুকুম নেই, কিন্তু সত্যবতীকে কেউ এঁটে উঠতে পারে না। ও যখন তখন দাওয়ার নিচে থেকে নাক বাড়িয়ে হাঁক পাড়ে, অ-ঠাকুরমা অথবা অ-পিসঠাকুরমা!
দীনতারিণী ওর গলা পেয়েই নিজের গলাটা বাড়িয়ে দরজা দিয়ে উঁকি মেরে বলেন, এই মলো যা, এ ছড়ি কি দস্যি গো! আবার এসেছিস? বেরো বেরো, ছোটঠাকুরঝি দেখতে পেলে আর রক্ষে রাখবে না!
সত্যবতী ঠোঁট উল্টে বলে, ছোটঠাকুরমার কথা বাদ দাও। তুমি শোন না একটু।
সত্যবতী দীনতারিণীর উপায়ী ছেলের মেয়ে, তাছাড়া সত্যর বিয়ে হয়ে গেছে, কাজেই খুব দূর-ছাইটা ওর কপালে জোটে না। তাই ওর আবদারে অগত্যাই দীনতারিণী একটু ডিঙি মেরে দাওয়ায় এসে দাঁড়ালেন। ইশারায় বললেন, কি চাই?
সত্যবতী পিঠের দিকে গোটানো হাতটা ঘুরিয়ে একখানা ছোট মাপের কচি মানপাতা মেলে ধরে চুপি চুপি বলে একটা জিনিস দাও না!
এই মরেছে, এখন আবার জিনিস কি রে? এখন কি কিছু রান্না হয়েছে? আর হলেও তোর সেজঠাকুরমার গোপালের ভোগের আগ আগে দিয়েছি, টের পেলে কুরুক্ষেত্তর করবে না?
আগ চাই নি, আগ চাই নি, ভালমন্দ রোধে নিজেরাই খেয়ো বাবা, আমাকে একমুঠো পান্তাভাত দাও দিকি!
পান্তাভাত?
দীনতারিণী আকাশ থেকে পড়লেন। আর সঙ্গে সঙ্গে যেন পাতাল ফুড়ে উঠলেন মোক্ষদা। রনে সপাসপে। ভিজে থান, কাখে ভরন্ত কলসী।
এইটা বোধ করি মোক্ষদার তৃতীয় দফা স্নান।
যে কোন কারণেই হোক, চাল ধুতে কি শাক ধুতে ঘাটে গেলেই মোক্ষদা একবার সবস্ত্ৰ স্নান সেরে নেন। দাওয়ার পৈঠে দিয়ে কখন যে উঠে এসেছেন, ঠাকুরমা নাতনী কারো চোখে পড়ে নি, চোখ পড়লো একেবারে সশরীরিণীর উপর।
দীনতারিণী অপ্ৰতিভের একশেষ, সত্যবতী বিরক্ত।
আর মোক্ষদা?
তিনি হাতেনাতে চোর ধরে ফেলা ডিটেকটিভের মতই উল্লসিত।
আবার তুই এখেনে! খনখনে গলায় প্রশ্ন করেন মোক্ষদা।
সত্যবতী ঈষৎ আমতা আমতা করে বলে, বাঃ রে, আমি কি তোমাদের দাওয়ায় উঠেছি?
দাওয়ায় উঠিস নি, বলি সকড়ি রাস্তা মাড়িয়ে এসে সেই পায়ে ওই উঠোনে তো পা দিয়েছিস! তুলসী গাছে জল দিতে উঠোনে নামতে হবে না। আমাদের?
সত্যবতী গোজ গোজ করে বলে, নামবার সময় তো দশঘড়া জল না ঢেলে নামো না, তবে আবার অত কি?
মুখে মুখে চোপা করিসনে সত্য, অব্যেস ভাল করা, মোক্ষদা ঘড়াটাকে দুম করে রান্নাঘরের চৌকাঠের ওপিঠে বসিয়ে আঁচল নিংড়ে নিংড়ে পায়ের কাদা ধুতে ধুতে বলেন, বাপের সোহাগে যে একেবারে ধিঙ্গী পদ পেয়ে বসে আছিস, বলি শ্বশুরঘর করতে হবে না? পরের বাড়ি যেতে হবে না? আর কদিন ধিঙ্গীনাচ নেচে বেড়াবি? মেরে কেটে আর দুটো-চারটে বছর, তাপর গলায় রসুড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে যাবে না? তখন করবি কি?
প্রতি কথায় এই পরের ঘরে যাওয়ার বিভীষিকা দেখিয়ে দেখিয়ে জব্দ করার চেষ্টাটা দু-চক্ষের বিষ সত্যবতীর। বরং তাকে ওরা ধরে দু-ঘা মারুক, সহ্য হবে। কিন্তু ওই পরের ঘরের খোঁটা সয় না। অথচ ওইটিই যেন এদের প্রধান ব্ৰহ্মাস্ত্ৰ। সত্যবতী তাই বিরক্তভাবে বলে, করবো। আবার কি!
কি আর করবি? উঠতে বসতে শাউড়ীর ঠোনা খাবি। ওই পটলা ঘোষালের ভাইপো-বেঁটার মতন ঠোনা খেতে খেতে গালে কালসিটে পড়ে যাবে।
সত্যবতী বয়েস-ছাড়া ভঙ্গীতে ঝঙ্কার দিয়ে বলে ওঠে, ছিষ্টি সংসারের লোক তো আর পটলকাকার ভেজের মতন দজল নয়!
ওমা ওমা, শোন কথা মেয়ের, মোক্ষদা হত্তেলের রং নিটোল টাইট হাত দুখানা নেড়ে বললেন, তা বলবি বৈকি! বোর দোষ হলো না, দোষ হলো শাউড়ীর! অবাধ্য চোপাবাজ বৌকে কি করবে শুনি? টাটে বসিয়ে ফুল-চন্দন দিয়ে পূজো করবে?
আহা পূজো করা ছাড়া আর কথা নেই যেন! একটু ভাল চোখে চাইতে পারে না! দুটো মিষ্টি কথা বলতে পারে না!
ও মাগো! মোক্ষদা খনখনে গলায় হেসে উঠে বলেন, ভেতরে ভেতরে মেয়ে পাকার ধাড়ি হয়েছেন! দেখবো লো দেখবো, তোর শাউড়ী কি মধুঢালা কথা কইবে! কত সোনার চক্ষে দেখবে!… সে যাক, বলি পান্তাভাতের কথা কি বলছিলি?
এতক্ষণ চুপ ছিলেন, এবারে দীনতারিণী হাসেন।
হেসে ফেলে বলেন, ও আমার কাছে এসেছে পান্তাভাত চাইতে।
পান্তাভাত চাইতে এসেছে! মোক্ষদা সহসা যেন ফেটে পড়েন, আমাদের হেঁসেলে পান্তা চাইছে, আর তুমি সেই শুনে গা পাতলা করে হাসছ নতুন মেজবৌ? আর কত আহ্লাদ দেবে নাতনীকে? পরকাল যে ঝরঝরে হয়ে যাচ্ছে! বলি শ্বশুরবাড়ি গিয়ে যদি বিধবার হেঁসেল থেকে দুটো পান্তা চেয়ে বসে, তারা বলবে কি? একথা ভাববে না যে, আমরা বুঝি গপগপ কয়ে বাসিহাঁড়ির ভাতগুলো গিলি! বলো বলবে কি না?
তাই কখনো কেউ বলে ছোটঠাকুরঝি! দীনতারিণী কথাটা হালকা করতে একটু কষ্টহাসি হেসে বলেন, ছেলে-বুদ্ধি অজ্ঞানে কি না বলে!
ছেলে-বুদ্ধি! ও মা লো! সোয়ামীর ঘর করতে পাঠালে ও এখন ছেলের মা হতে পারে, বুঝলে নতুন মেজবৌ! মোক্ষদা কাঁধ থেকে গামছাখানা নিয়ে জোরে জোরে ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, মেয়ের বাক্যি-বুলি শোন না তো কান দিয়ে? সোহাগেই অন্ধ! এই তোকে সাবধান করে দিচ্ছি সত্য, খবরদার পাঁচজনের সামনে এমনি বেফাঁস কথা বলে বসবি না! পাড়াপাড়শী উনুনমুখীরা তো মজা দেখতেই আছে, এমন কথাটা শুনলে ঠিক বলবে আমরা বাসি হাঁড়িতে খাই!