যাদের একটু কম ঈর্ষা হল, তারা বলল, তবু বলতে হবে উদ্যোগী পুরুষ! আর জাতিচু্যতই বা হবে কেন? কুঞ্জ তো বলছে নাকি জেনে এসেছে গোবিন্দ গুপ্ত রামকালী চাটুয্যের জন্যে কোন এক বামুনবাড়িতে ভাতের ব্যবস্থা করে রেখেছে।
গ্রামে আবার কিছুদিন এই নিয়ে আলোচনা চলল। এবং যখন এসব আলোচনা ঝিমিয়ে গিয়ে ক্রমশ আবার সবাই রামকালীর নাম ভুলতে বসল, তখন একদিন রামকালী সশরীরে হাজির হল টাকার বস্তা নিয়ে।
গোবিন্দ গুপ্ত পরামর্শ দিয়েছেন, তোমার আর রাজবদ্যি হয়ে কাজ নেই বাপু, রাজ্যে এখন ভেতরে ভেতরে ঘুণ ধরতে বসেছে, নবাবের নবাবী তো শিকেয় উঠেছে। আমার এই দীর্ঘকালের সঞ্চিত অৰ্থরাশি নিয়ে দেশে পালিয়ে গিয়ে নিজে নবাবী করো গে। আমরা স্ত্রী-পুরুষ উভয়ে কাশীবাসে মনঃস্থির করেছি!
অগত্যা চলে এসেছে রামকালী।
গঞ্জের ঘাট থেকে নিজের পালকি করে।
গোবিন্দ গুপ্তের পালকিটাও পেয়েছে রামকালী। নৌকায় চাপিয়ে নিয়ে এসেছে।
কিন্তু তখন জয়কালী মারা গেছেন এই এক মস্ত আপসোস।
বাবাকে একবার দেখাতে পারল না। রামকালী, সেই তাড়িয়ে দেওয়া ছেলেটা মানুষ হয়ে ফিরল।
০২. গঞ্জে মেলায় যেমন
গঞ্জে মেলায় যেমন লোক দল বেঁধে পাঁচপেয়ে গরু দেখতে ছোটে, তেমনি করে দেশের সমস্ত লোক আসতে লাগল রামকালীকে দেখতে। রামকালী মনে মনে বিব্রত হলেও সকলকে যথোচিত মান্য করল এবং বয়োজ্যেষ্ঠ সকলকে একজোড়া করে ধুতি ও নগদ টাকা দিয়ে প্রণাম করল।
ঘরে ঘরে সবাই বলাবলি করতে লাগল, উঃ, কী উঁচু নজরটাই হয়ে এসেছে! অনেকে নিজের নিজের চিরদিন বাড়ি বসে থাকা ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলল।
তবু কিছুদিন একটু জাতে-ঠেলা জাতে-ঠেলা হয়ে থাকতে হয়েছিল বৈকি রামকালীকে। বারবাড়িতে শুত, খেত, বাড়ির ছোট ছেলে।পুলে দৈবাৎ কেউ রামকালীকে ছুঁয়ে ফেললে তাকে কাপড় ছাড়ানো হত। কিন্তু রামকালীই একদিন গ্রামকর্তাকে ডেকে সালিশ মানল।
এটা কেন হবে?
একটি দিনের জন্যে সে বৈদ্যের অন্ন গ্রহণ করে নি, এক দিনের জন্য কোন অনাচার করে নি, শুধু শুধু পতিত হয়ে থাকতে হবে কেন তাকে?
গ্রামকর্তারা মাথা চুলকে হেঁ হেঁ করতে লাগলেন, স্পষ্ট কিছু বলতে পারলেন না। কারণ ছোঁড়াটা নাকি রাজবদ্যি গোবিন্দ গুপ্তর সমস্ত বিদ্যে আর সমস্ত টাকা হাতিয়ে নিয়ে এসেছে।
তাছাড়া ছোঁড়ার হাতটা দরাজ।
কর্তাদের হেঁ হেঁ করার অবসরে রামকালী নিজের বক্তব্য ব্যক্ত করল, দেখুন। আমার গুরুর ওষুধ ডেকে কথা কয়। আমি তার কিছু-কিঞ্চিৎ আশীৰ্বাদও তো পেয়েছি। সে বিদ্যে আমার জন্মভূমির, আমার পাড়াপাড়শীর, আমার জ্ঞাতি-গোত্তরের কাজে লাগুক এই আমি চাই। তবে যদি আপনারা তা না চান, তা হলে আবার আমাকে গ্রামের বাস উঠিয়ে চলে যেতে হবে।
এবার গ্রামকর্তারা হা হা করে উঠলেন। সত্যিই তো, কথাটা তো উড়িয়ে দেবার নয়? সকলেরই একদিন না একদিন নিদেনকাল আছে।
ওঁদের হাঁ-হাঁর অবসরে রামকালী বললে, এই যে একটি পুকুর কাটাবার ইচ্ছে হয়েছে, সেই উপলক্ষ্যে গ্রাম-ভোজন দেব। আশা করে বসে আছি, সে আশা তা হলে পূরণ হবে না!
এরা আবার দ্বিধাশূন্য হয়ে ‘সে কি? সে কি?’ করে উঠলেন।
আর ইত্যবসরে ফেলু বাঁড়ুয্যে এক চাল চেলে বসলেন। কি এক সংস্কৃত শ্লোক আউড়ে বললেন হেসে হেসে, জানো তো, উপর্যুক্ত বয়সে বিবাহ-সংস্কার না হলে কন্যা যেমন অরক্ষণীয়া হয়, পুরুষও তেমনি পতিত হয়।
রামকালী মাথা নীচু করে বললে, বয়স প্রায় ত্ৰিশ পার হতে চলল, এ বয়সে কে আমাকে কন্যাদান করবে?
ফেলু বাঁড়ুয্যে বীরদৰ্পে বলে উঠলেন, আমি করব। এতে আমার ভায়েরা আমাকে জাতে ঠেলেন তো ঠেলুন।
ফেলু বাঁড়ুয্যেকে জাতে ঠেলা! জাতের যিনি মাথা!
‘হাঁ-হাঁ’র স্রোত বইতে লাগল সভায়।
আর ফেলুর চালাকি দেখে মনে মনে সবাই নিজেদের গালে মুখে চড়াতে লাগল। মেয়ে আর কার ঘরে নেই!
এরই কিছুদিন পরে ফেলু বাঁড়ুয্যের ন বছরের মেয়ে ভুবি। বা ভুবনেশ্বরীর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল রামকালীর।
বহুদিন এত ঘটার বিয়ে হয় নি গ্রামে।
কারণ রামকালী নাকি নিজে পাঁচ-পাঁচশ টাকা লুকিয়ে ওর মা দীনতারিণীর হাতে গুঁজে দিয়েছিল। ঘটা করতে।
এই বেহায়ামিটা যথেষ্ট নিন্দনীয় সন্দেহ নেই, কিন্তু ঘটার মাছমোণ্ডাগুলো অনিন্দনীয় ছিল।
অতএব রামকালী পুনশ্চ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। অনুমতি পেল বাড়ির মধ্যে গিয়ে খাবার শোবার।
যাক, তার পরও তো কাটল কতকাল।
সেই ভুবি। বড় হল, ঘর-বসতি হল, পনেরো-ষোলো বছরের ভরা-নদী হল। তার পর তো সত্যবতী।
বুড়ো বয়সের প্রথম সন্তান বলেই হয়তো বাপের কাছে কিছু প্রশ্ৰয় আছে সত্যবতীর।
০৩. দীনতারিণী নিরামিষ ঘরে
দীনতারিণী নিরামিষ ঘরে রান্না করছিলেন, সত্যবতী দাওয়ার নীচের ছাঁচতলায় এসে দাঁড়াল। উঁচু পোতার ঘর। দাওয়ার কিনারাটা সত্যবতীর নাকের কাছাকাছি, পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর সমস্ত দেহভারটা দিয়ে ডিঙি মেরে গলা বাড়িয়ে সত্যবতী তার স্বভাবসিদ্ধ মাজাগলায় ডাক দিল, অ ঠাকুরমা, ঠাকুরমা!
নিরামিষ হেঁসেলের দাওয়ায় ওঠবার অধিকার সত্যবতীর কেন, বাড়ির মেটে দাওয়ার একপেশে কোণা থেকে খাজ কেটে সিঁড়ি বানানো হয়েছে, আর সে সিঁড়ি থেকে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাওয়া পথ হয়েছে একেবারে ঘাট বরাবর। দীনতারিণী, দীনতারিণীর সেজজা শিবজায়া, দীনতারিণীর দুই ননদ কাশীশ্বরী আর মোক্ষদা–মাত্র এঁরাই এই পথে পদক্ষেপের অধিকারিণী। ঘড়া নিয়ে ঘাটে যান এবং স্নান সেরে ঘাড়া ভরে ভিজে কাপড়ে পায়ে পায়ে এসে একেবারে ওই সিঁড়ি কটি দিয়ে স্বৰ্গে উঠে পড়েন। ওই রান্নাঘরের দেওয়ালেই তাদের কাঁচাকাপড় শুকোয়, কারণ রাত্রে তো আর এঘরে রান্নার পাট নেই। ঘর নিকোনোর কাজেও কিছু আর অছ্যুৎরা কেউ এসে ঢুকবে না। সে কাজ মোক্ষদার। এটোসিকড়ির ব্যাপারে মোক্ষদা বোধ করি স্বয়ং ভগবানকেও সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারেন না। কাজেই সে কাজ নিজের হাতে রাখেন। তা ছাড়া মোক্ষদাই বয়সে সব চেয়ে ছোট, অন্যান্যরা সকলেই তাঁর গুরুজন, অতএব সকলের খাওয়ার শেষে তারই ডিউটি।