ঘাটেপথে বেরিয়ে গাছের পাতা নড়ার শব্দে শিউরে ওঠে শঙ্করী, বাঁশের সরসরানি শুনলে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু?
সে ভয় কি শুধুই ভয়? নিছক ভয়?
তার সঙ্গে ভয়ানক একটা আশাও জড়ানো নেই?
সর্বদা কি মনে হয় না, হঠাৎ কোন একটা বাঁশবাগানের ধারে, কি পুকুরঘাটের কাছে সেই সর্বনেশে লোকটাকে দেখতে পায় তো আর বাড়ি ফেরে না।…
কাল শুনেছে, বিয়ে উপলক্ষে কাকার বাড়ি থেকে নেমন্তনিতে আসবে। কাল থেকে তাই মরে আছে শঙ্করী।
কি জানি কি বলবে খুড়ো কি খুড়তুতো ভাইরা এসে!
নগেন কি সব বলে বেড়িয়েছে?
নগেন কি ওখানে আছে এখনও?
নগেন কি বেঁচে আছে?
হয়তো টের পেয়ে সবাই মেরে ফেলেছে।
সেদিন কেন আমবাগানে গিয়েছিল শঙ্করী? আর যে লোকটা তাকে মন্দ পথে টানবার চেষ্টা করছিল, কেন আজও শঙ্করীর মনকে লক্ষ দড়িদড়া দিয়ে টানছে সে?
মরতে গিয়েও কেন মরতে পারে না শঙ্করী!
পৃথিবীতে শঙ্করী বলে একটা মেয়েমানুষ যদি না থাকে কি এসে যাবে পৃথিবীর! কলঙ্কিত মন নিয়ে ঠাকুরঘরের কাজ করছে সে, তুলসীতলায় প্রদীপ দিচ্ছে, এ মহাপাপের ফল–
চিন্তায় বাধা পড়ল।
কাশীশ্বরী এসে দাঁড়িয়েছেন, তীব্রকণ্ঠে ডাকছেন, নাতবৌ!
১২. সত্যর মনের কাছে এত বড় ভয়ের পরিচয়
ভয়! ভয়!
সত্যর মনের কাছে এত বড় ভয়ের পরিচয় বোধ করি এই প্রথম।
কাটোয়ার বৌয়ের খুব যে একটা খোয়ার হবে এটা আশঙ্কা করছিল সত্য, কিন্তু এ কি! তিরস্কারের এ কোন ভাষা? জীবনে অনেক কথা শুনেছে সত্য, অনেক কথা শিখেছে, কিন্তু এসব শব্দ তো কখনো শোনে নি।
অসতী মানে কি? উপপতি কাকে বলে? কুল খাওয়া বলতেই বা কি বোঝায়?
যে কুলের আচার তৈরি হয়, আর তেলে-নুনে জরিয়ে অপূর্ব আস্বাদন পাওয়া যায়, এটা যে ঠিক সে জাতীয় নয়, এইটুকুই শুধু বুঝতে পারে সত্য। কিন্তু তার পরই কেমন দিশেহারা হয়ে যায়। দূর থেকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে শঙ্করী আর কাশীশ্বরীর দলের দিকে।
না, আর কেউ কিছু বলছে না, সবাই নিথর, এমন কি মোক্ষদা পর্যন্ত কেমন যেন স্তব্ধ, একা কাশীশ্বরীই পালা চালিয়ে যাচ্ছেন, চাপা তীক্ষ্ণ গলায়।
শঙ্করীকে ধরে চিবিয়ে খেলেও বুঝি রাগ মিটবে না, এমনি সব মুখভঙ্গী।
মোক্ষদা এক ধরনের, কাশীশ্বরী আর এক ধরনের। মোক্ষদার অটুট গতর, অসীম ক্ষমতা, অনর্গল বাকপটুত্ব। কিন্তু কাশীশ্বরীর তা নয়। কাশীশ্বরী শোকেতাপে কিছুটা অথর্ব, তাছাড়া চিরদিনই তিনি টেপামুখী। শুধু তেমন মোক্ষম অবস্থায় পড়লেই মুখ দিয়ে কথা বেরোয় তাঁর চাপা তীক্ষ্ণ।
কিন্তু আজকের মত এমন সব কথা কবে বেরিয়েছে কাশীশ্বরীর মুখ দিয়ে? এমন ঘৃণা-জর্জরিত মুখই বা কবে দেখা গেছে তাঁর?
কে গিয়েছিল কাটোয়ায়?
কে কি শুনেছে এসেছে সেখান থেকে? বার বার শঙ্করীর বাপেরবাড়ির কথাই বা উঠছে কেন? তারা নাকি কেউ ভোজবাড়িতে আসবে না, সম্পর্ক রাখতে চায় না শঙ্করীর সঙ্গে। নেহাৎ নাকি তারা শঙ্করীর মা-বাপ নয়, খুড়োখুড়ী, তাই অমন মেয়েকে টুকরো টুকরো করে কেটে কাটোয়ার গঙ্গায় ভাসিয়ে দেয় নি।
আরও কত কথা, তার সঙ্গে কত মুখভঙ্গী!
শঙ্করীকে গলায় দড়ি দিয়ে মরবার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, দেওয়া হচ্ছে ঘাটে ডুবে মরবার নির্দেশ! পাপিষ্ঠা শঙ্করীর পাপস্পর্শেই যে কাশীশ্বরীর একমাত্তর নাতিটা বিয়ের বছর না ঘুরতেই মরেছে, সেকথাও প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে আজকের বিচারের রায়ে।
অনেক শুনতে শুনতে শেষ পর্যন্ত এইটুকু বুঝতে পারে সত্য, নাপিত-বৌ আর রাখু কাটোয়া গিয়েছিল যজ্ঞির জন্যে নেমন্তন্ন করতে। আর শঙ্করীর খুড়ী নাপিত-বৌয়ের কাছে শঙ্করীর নামে যাচ্ছেতাই করেছে।
সেখান থেকে খুব যে একটা গর্হিত কাজ করে চলে এসেছে শঙ্করী, সে বিষয়ে আর সন্দেহমাত্র নেই। লক্ষ্মীর ঘরে সন্ধ্যা দিতে দেরি হওয়া অথবা সাঁঝ-সন্ধ্যে পর্যন্ত ঘাটে বসে থাকার চাইতে যে অনেকে বেশী গর্হিত তা বুঝতে পারা যাচ্ছে।
কিন্তু শঙ্করীর অপরাধের সঙ্গে তার খুড়ীর বোনগোর যোগ কোথায়? সে কেন শঙ্করীর জন্যে বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দিশ হয়ে চলে গেছে?
এইখানেই সব গোলমাল লাগছে সত্যর।
সব যেন হেঁয়ালি।
এই অন্য জগতের অর্থবহ, জীবনে না-জানা শব্দগুলো সত্যর বুকটাকে কেমন হিম-হিম করে দিচ্ছে। ভয় করছে। যে অনুভূতি জীবনে জানে না সত্য, আজ সেই অনুভূতি তার সমস্ত সাহসকে যেন বোবা করে দিয়েছে।
গিন্নীরা কাউকে শাসন করছেন, অথচ সত্য তার মধ্যে ফোড়ন কাটছে না, এমন ঘটনা বোধ করি সত্যর জ্ঞানে এই প্রথম। অপরাধীর পক্ষ নেওয়াই সত্যর স্বভাব। তা সে অপরাধী যে শ্রেণীর হোক।
একবার বাসন-মাজুনী বাণী-বৌ সন্ধ্যে করে ঘাটে বাসন মাজতে গিয়ে পাজার বাসন থেকে একটা বাটি হারিয়ে ফেলেছিল। খুব সম্ভব বাটিটা জলেই ডুবে গিয়েছিল, কিন্তু বাণী-বৌকে ‘চোর’ অপবাদ দিয়ে ন ভূতো ন ভবিষ্যতি করেছিলেন শিবজায়া আর দীনতারিণী। এবং মোক্ষদা হুকুম দিয়েছিলেন, না যদি নিয়েছিস তো সমস্ত রাত ওই পুকুর হাতড়ে বাটি খুঁজে বার কর।
বান্দী-বৌ যত হাউমাউ কাঁদে, গৃহিণীকুল ততই চেপে ধরেন তাকে। চুরির উদ্দেশ্যেই যে সে বেলা গড়িয়ে বাসন মাজতে আসে এ মন্তব্যও করতে ছাড়েন না তারা। সেযাত্রা সত্যই তো রক্ষে করেছিল বান্দী-বৌকে।
বলেছিল, চল বান্দীবৌ, আমিও খুঁজিগে তোর সঙ্গে। আমি খুব সাঁতার জানি, সাঁতরে এপার ওপার করে বাটি হাতড়াব।