এইটাই কি একটা নেয্য কথা হল? না নগেনদাদা, তোমার পায়ে ধরি, আমায় ছেড়ে দাও। কেউ যদি এ অবস্থায় দেখে ফেলে, তা হলে আর আমার ঘরে ঠাই হবে না।
ভালোই তো– নগেন হাতটা ছেড়ে দেওয়ার পরিবর্তে আরও জোরে চেপে ধরেছিল, বুঝিবা একটু কাছেও টেনেছিল, বলেছিল, ঘর থেকে দূর করে দিলে আমাদের সুরাহাই হবে। কলঙ্ক ছড়ালে শ্বশুরবাড়ি থেকেও নেবে না তোকে, তখন দুজনে চলে যাওয়া সোজা হবে। শাপে বর হবে আমাদের।
না না, নগেনদাদা, হাত ছাড়। তোমার মনে এত কু জানলে কখনো এখানে আসতাম না আমি। তুমি বললে একটা কথা আছে–
নগেন কখনো যা না করেছে তাই করল। অগ্নিমূর্তি হয়ে খিঁচিয়ে উঠল, ন্যাকামি করিস নে। জানলে আসতাম না! তোর সঙ্গে আমার কি ভাগবত-কথা থাকবে শুনি? আমি বলছি তুই আমার সঙ্গে পালিয়ে চল!
সজ্ঞানে নয়, অসতর্কে মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল, কোথায়?
নগেন মহোৎসাহে বলে ওঠে, যেখানে হোক। অনেক দূরের কোন গাঁয়ে। সেখানে শুধু তুই আর আমি সুখে সংসার করব। ছোট্ট একখানা মাটির কুঁড়ে, একটু শাকপাতার বাগান, একটা একছিট্টে পুকুর, এর বেশী আর কি চাই আমাদের ব! তা সেটুকু সংস্থান করতে পারব। পেটে তো একটু বিদ্যে করেছি, কিছু না পারি একখানা পাঠশালা খুলব। কারুর কোন ক্ষেতি নেই তাতে শঙ্করী।
বুকের মধ্যেকার সেই ঢেঁকির পাড় পড়াটা বন্ধ হয়ে কী এক কাঁপা কাঁপা সুখে মনটা দুলে উঠল শঙ্করীর? চোখ দুটো কি জলে ভরে এল না? নতুন ফাগুনের সেই থেকে থেকে ঝিরি ঝিরি, থেকে থেকে দমকা বাতাসে শরীরটা কেমন অবশ-অবশ হয়ে আসে নি কি? মনে কি হয় নি, সত্যিই তো- তাতে কার কি ক্ষতি? শ্বশুরবাড়ি সে চোখে দেখে নি, এক দিনও ঘর করে নি। চেনে না তাদের, জানে না শঙ্করীকে না পেলে কার কি সুখ-দুঃখ, কার কি লাভ-লোকসান! কাকারা যদি খবর দেয়, শঙ্করী বলে যে একটা মেয়ে ছিল তাদের ঘরে যে নাকি কবরেজ-বাড়ির ভাগ্নেবৌ ছিল– হঠাৎ ওলাওঠা হয়ে মরে গেছে সে, কত কাঁদবে কবরেজ-বাড়ির লোকেরা?
আর কাকা-খুড়ী?
মরে গেছে বলে রটিয়ে দিলে সমাজের কাছে পার পাবে না?
না, বেশীক্ষণ এ চিন্তা মনে স্থান পায় নি। বাতাসটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে ভয়ানক যেন গুমোট হয়ে উঠল, চেতনা ফিরে পেল শঙ্করী। বলে উঠল, হিদুর ঘরের বিধবাকে বেরিয়ে যাবার কুমন্তরণা দিতে লজ্জা করে না তোমার? তুমি না আমার ভাইয়ের মতন?
না, কখনো না! গর্জে ওঠে নগেন, কখনো ভাইয়ের মতন নয়। সে কথা তুইও ভাল জানিস, আমিও ভাল জানি। চিরদিন মনে মনে আমি তোকে পরিবারের মতন দেখে এসেচি। জেনেশুনে কেন মিছে বাকচাতুরি করছিস! কথা দে, দুপুররাতে তুই খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে এসে এখানে দাঁড়াবি, আমি আগে থেকে দাঁড়িয়ে থাকব। তার পর জোর পায়ে হেঁঠে গাঁ থেকে একবার বেরোতে পারলে কে ধরে? খুঁজতে তো আর পারবে না মাসী-মেসো? কিল খেয়ে কিল চুরি করে বসে থাকতে হবে!
ও নগেনদাদা, আমার বুকের ভেতরটা কেমন করছে, ছেড়ে দাও আমায়। আমি পারব না।
পারতেই হবে তোকে। নগেন ব্যাকুল স্বরে বলে, যতক্ষণ না তুই মত দিবি, ছাড়ব না হাত! দেখুক পাঁচজনে, সেই আমি চাই।
নগেনদাদা, আমি চেঁচিয়ে লোক জড়ো করব। আলগা আলগা দুর্বল স্বরে বলে শঙ্করী, বলব বাগানে একলা পেয়ে তুমি আমাকে
নগেন বেপরোয়া, বলে, চেঁচা। জড়ো কর লোক।
নগেনদাদা গো, আমাকে বরং মেরে ফেল।
আমি আর কি মারবো তোকে? মেরেই তো ফেলেছে সবাই মিলে। বাপের বাড়িতেই লাথি ঝটা না খেয়ে একমুঠো ভাত জুটছিল না, মরার ওপর খাঁড়ার ঘা, এর পর আবার শ্বশুরবাড়ি সারা জন্মটা শুধু লাথি-ঝাটা সার। আমিই বরং তোকে বাঁচাতে চাই। আদর করে যত্ন করে মাথার মণি করে রাখতে চাই।
আমি চাই না তোমার আদর-যত্ন। এবার একটু দৃঢ় শোনাল শঙ্করীর কণ্ঠস্বর, লাথি-ঝাঁটাই আমার ভাল।
বটে! লাথি-ঝাটাই তোর ভাল? নগেন সহসা মারমুখী হয়ে একটা কাজ করে বসল।
হ্যাঁ, আদর করে প্রেমালিঙ্গন নয়, মারমুখী হয়ে সহসা শঙ্করীকে সাপটে জড়িয়ে ধরল নগেন, ধরে বলে উঠল, বেশ, সেটাই যাতে আরও ভাল করে খাস তার ব্যবস্থা করছি। এই দিচ্ছি দেগে, তার পর তোর শ্বশুরবাড়ির গায়ে রটাব, ও আমার সঙ্গে মন্দ–
কী ভাবে যে নগেনের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিল শঙ্করী, কী ভাবে যে একেবারে ঘাটে ডুব দিয়ে বাড়ি গিয়ে বলেছিল বকুলফুলের বাড়ি যাওয়া হল না, রাস্তায় একখানা ছুতোহাড়ি পায়ে ঠেকে গেল বলে একেবারে নেয়ে বাড়ি ফিরতে হল, আর কি করে যে অসময়ে নেয়ে মাথাটা ভার হয়েছে বলে দিনের বাকী সময়টা শুয়ে কাটাল, সে আর ভাল করে মনে পড়ে না শঙ্করীর।
শুধু মনে আছে তার প্রবল কান্নার ব্যাপার দেখে কাকাসুদ্ধু মমতা-মমতা গলায় সান্ত্বনা দিয়েছিল, কেন কাঁদছিস মা, মেয়েমানুষকে তো শ্বশুরঘর করতেই হয়। সেই হচ্ছে চিরকালের জায়গা। তা ছাড়া কবরেজ মশাই অতি সজ্জন ব্যক্তি, সংসারে খাওয়া-পরার কোন দুঃখু নেই, ভাল থাকবি, সুখে থাকবি।
তবু আরও আকুল হয়ে কেঁদেছিল শঙ্করী। অগত্যা খুড়ীকে পর্যন্ত বলতে হয়েছিল, আবার আসবি, পালাপার্বণে আসবি, আমরা কি তোকে পর করে দিচ্ছি?
.
বছর ঘুরে গেল, খুড়ীর প্রতিশ্রুতি খুড়ী রাখে নি। নিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, একবার উদ্দিশ পর্যন্ত করে নি। সে গাঁয়ের এক কানাকড়া খবরও আর সেই অবধি পায় নি শঙ্করী। শুধু অবিরত কাটা হয়ে থেকেছে, ওই বুঝি কে বলে, নগেন বলে একটা ছেলে এসে গ্রামে কি রটিয়ে বেড়াচ্ছে শঙ্করীর নামে!